আমেরিকা এবং সমকালীন মুসলমান সমাজ (২০০৪ সাল পর্যন্ত) – পর্ব ১
গত দুই দশকে আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম প্রায় মুমূর্ষু অবস্থা হতে সংখ্যা, শক্তি, স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে আজ বিচিত্র সংস্কৃতির একটি ধর্মীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। একটু পেছন থেকেই শুরু করা যেতে পারে। ১৯৯৮ সালের ৩ জুলাই সমগ্র দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া হতে তিন হাজারের বেশি মুসলমান লস এঞ্জেলেসের বুয়েজা পার্কে মিলিত হন। লস অ্যাঞ্জেলেস হতে শুরু করে সান্টিয়াগো পর্যন্ত নানা স্থানে ইসলামী সংগঠন এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিল। এই সম্মেলনে প্রতিনিধিবর্গ সকল সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল african-american মসজিদে ভারতীয় এবং এশিয়ানদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই সম্মেলনে ক্যালিফোর্নিয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রিচার্জ ডেকমিজিয়ান বলেন, আমেরিকার ইসলাম শুরু হয়েছিল অভিবাসীদের একটি ধর্ম হিসেবে। এখন ক্রমেই এটি একটি দেশজ ধর্মে পরিণত হচ্ছে। অতীতে মুসলমানরা তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে তাদের যে খল চরিত্র আঁকা হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আলোচনা করত। এখন তারা অধিকতর স্থিতিশীলতা অর্জন করে শিক্ষা এবং ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলা এবং এখানে নিজেদের ধর্মীয় জীবনযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারছে। কাল ভারসিটিতে ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মসজিদ উদ্বোধনের আগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই সময়ে ১৯৯৮ সালে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক কাউন্টির মুসলমানরা মসজিদ, স্কুল ও ইসলামিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে মুসলমানদের ব্যাপকভিত্তিক অভিবাসনের ইতিহাস মূলত পেছনের। ইতিহাস বলে ১৮৮০ সালে লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন হয়ে আমেরিকায় উল্লেখযোগ্যভাবে আগমন ঘটে মুসলমানদের। মূলত আমেরিকায় মসজিদকেন্দ্রিক মুসলিম সমাজ লক্ষ করা যেতে পারে। বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরতদের মধ্যে afro-american ৪২%, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ২৪.৪%, আরব অঞ্চলের ১২.৪%, আফ্রিকান ৫.২%, ইরানী ২.৪ %, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২.৪%, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ১.৬%, আলবেনীয় ৩.২% এবং বাকি ৫.৬% বিভিন্ন দেশের। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অফ ইসলামিক রিলেশনস দাবি করে যে, সারা আমেরিকায় মুসলমানদের সংখ্যা লক্ষাধিক, যা দুই দশক আগে ছিল ২০ লাখের মতো। কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী ৫ লক্ষাধিক মুসলমান বাস করে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এদের মধ্যে সোয়া দুই লাখ বসবাস করে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে এবং বাকি ১২০,০০০ বাস করে অরেঞ্জ কাউন্টিতে। পূর্বের ডাটায় একথা স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের প্রায় অর্ধেক হল afro-american। এদের অনেকেই ধর্মান্তরিত মুসলমান। মুসলমানদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এসেছে ভারত ও পাকিস্তান হতে। এ দুটো দেশ হতে আগত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। পাশ্চাত্যে ধারণা রয়েছে যে, মুসলমান মাত্রই আরবীয়দের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। অথচ কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের মাত্র ১২% এসেছে আরব হতে। আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন যে, বর্তমানে ইউএসএ তে ১২৮০ এবং কানাডায় ১২২ মসজিদ, উত্তর আমেরিকায় মোট ১৪০২টি মসজিদ এবং মুসলমানের এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে হামলার পর ইসলাম ধর্মের প্রচার কর্মকাণ্ডে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও প্রচার-প্রসার আশাব্যঞ্জক। প্রতিবছর ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজার। প্রতিরক্ষা বিভাগীয় তথ্য অনুযায়ী, গত মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় কমপক্ষে তিন হাজার সৈন্য ইসলাম গ্রহণ করে। উত্তর আমেরিকার ১৩৫টি মসজিদ হতে নিয়মিত ইসলাম প্রচার হচ্ছে। এছাড়া ১৪৩২টি মসজিদের কিছু কিছু হচ্ছে। প্রতিদিন এখানে প্রায় ৬০০ লোক ইসলাম প্রচার করে। ২২০ জন মাঝে মাঝে ইসলামের দাওয়াত দেয়। প্রতিমাসে দুই থেকে তিন দিন ৩৪০০ জন তাবলীগে যায়। ১২৯১টি ঘরে তালিম হয়। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫ জন প্রতিনিধি ইসলামের দাওয়াত দেয়। ২০০১ সালের গ্রীষ্মকালে ২৮৪টি জামাত (প্রতি জামাতে ১০ থেকে ১২ জন) ৪ মাস এবং ৪০দিনের জন্য তাবলিগে যায় ইজতেমা হতে। ইজতেমার আগে ২৮০টি জামাত সফরে বের হয়। ইজতেমায় ১৯ হাজার মুসলমান অংশগ্রহণ করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জামাত ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়েছিল ইসলামের দাওয়াতের জন্য। অপরদিকে ২০০০ সালে ১১২টি জামাত উত্তর আমেরিকায় ইসলামের দাওয়াত দিয়েছে। আমেরিকায় যেসব রাজ্যে মুসলমানের সংখ্যা অধিক সেগুলো হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ জার্সি, ইন্ডিয়ানা, ইলিনয়েস, ভার্জিনিয়া, মিশিগান, টেক্সাস ওহিও এবং মেরিল্যান্ড। এসব এলাকার এক হাজারের অধিক মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে ষাটের দশকে ২০০টি এবং আশির দশকে ৬০০টি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪০০টি স্কুল ও মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি পূর্বকালীন। ৮০টির বেশি জার্নাল এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয় ধর্মকেন্দ্রিক। বিগত দশকে মুসলমানরা তাদের সমাজকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৯০ সালে ওয়াশিংটনে আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে চারটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। আমেরিকান জীবনের সকল ক্ষেত্রে নানা বাধা সত্ত্বেও মুসলমানদের অংশগ্রহণ মোটামুটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে উচ্চপদে আসীন কেউ মহাশূন্য সংস্থা নাসায় কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিংবা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি নানা পদে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীতে ১৫,০০০ জন মুসলমান বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন। ১৯৮৭ সাল হতে মুসলমানগণ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম মুসলিম হিসেবে ক্যাপ্টেন হয়েছেন আব্দুর রশিদ মোহাম্মদ। [ড.আহমেদ আবদুল্লাহ]
তথ্যসূত্র:
১. দৈনিক ইত্তেফাক, ১ মার্চ ২০০৪, আমেরিকায ইসলাম ও মুসলমান, আবু তালিব বিন মফিজ
২. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ জুন ২০০২, আমেরিকা ও ইউরোপে ইসলাম ,ফরহাদ আহমেদ
৩. দৈনিক যুগান্তর, ১১ অক্টোবর ২০০২, মার্কিন মিডিয়ায় ইসলাম, শেখ গোলাম মোস্তফা
৪. দৈনিক যুগান্তর, ২৭ ডিসেম্বর ২০০২, আমেরিকায় কুরআন ও ইসলামের সম্ভাবনা, রবিউল আলম
৫. দৈনিক যুগান্তর, সত্যের সন্ধানে আমেরিকা, ১ জুলাই ২০০২, শাহেদ আহমেদ চৌধুরী
৬. দৈনিক দিনকাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম ধর্ম মূলধারায় প্রবেশ করছে।
আমেরিকা এবং সমকালীন মুসলমান সমাজ (২০০৪ সাল পর্যন্ত) – পর্ব ২