ঐতিহাসিক আমঝুপি নীলকুঠি | মেহেরপুর
অবস্থান | Location |
আমঝুপি নীলকুঠি মেহেরপুর জেলাধীন সদর উপজেলার আমঝুপি নামক গ্রামে অবস্থিত। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কস্থ আমঝুপি বাজার থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দক্ষিণে কাজলা নদীর তীরে এ নীলকুঠিটির অবস্থান। আমঝুপি নীলকুঠির ভূ-স্থানাঙ্ক (geo-coordinate) হল 23°44’28.5″N 88°40’41.3″E (23.741237, 88.678135)।
স্থাপত্যিক বিবরণ | Architectural Description |
কাজলা নদীর তীরের একটি বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠা আমঝুপি নীলকুঠিটি বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনবিশিষ্ট ১টি বিশাল কমপ্লেক্স। উত্তরমুখী এ কমপ্লেক্সের বহু প্রাচীন নিদর্শন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এর কিছু কিছু নবরূপে টিকে আছে। বর্তমানে আমঝুপি নীলকুঠি কমপ্লেক্সটিতে স্মৃতি নিদর্শন স্বরূপ নীলকুঠি ভবন, নায়েবের ঘর, কোয়াটার, পাম্প, ঘোড়ার ঘর, আমলাপাড়া, কালভার্ট এবং ধ্বংসাবশেষের আরও কয়েকটি ঢিবি অবশিষ্ট আছে। এসব নিদর্শন সম্পর্কে উল্লেখ করা হল:
নীলকুঠি ভবন: উত্তরমুখী আমঝুপি নীলকুঠি মূল ভবনটির দৈর্ঘ্য ৩৭.৬৪মিটার এবং প্রস্থ ২২.২৫মিটার। ১৩টি কক্ষবিশিষ্ট এ ভবনের সামনে ও পিছনে ১টি করে বারান্দা রয়েছে। সামনে ও পিছনের বারান্দা থেকে ভবনটির ভিতরের কক্ষসমূহে প্রবেশের জন্য একাধিক প্রবেশপথ রয়েছে। বারান্দার চালায় অ্যাসবেস্টস ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদ তৈরিতে কাঠের বর্গা ব্যবহার করা হয়েছে। সাটার(খড়খড়ি)বিশিষ্ট দরজা এবং জানালার কপাটগুলো কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। নীলকুঠির অভ্যন্তরে স্নেক প্রুফ মেঝে এবং গরম রাখার জন্য ১টি ফায়ার প্রেস এ ভবনের উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। নীলকুঠির বারান্দায় নকশাযুক্ত স্তম্ভসহ লোহার রেলিং রয়েছে।
স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ: নীলকুঠি ভবন থেকে প্রায় ১০০মিটার পশ্চিম দিকে এবং কাজলা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁসে স্থাপনার দেয়ালের ১টি ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩২মিটার দীর্ঘ এ দেয়ালটি চওড়ায় ৬০সেন্টিমিটার। এ ধ্বংসাবশেষের দেয়াল দেখে প্রতীয়মান হয়, প্রায় ৫টি কক্ষবিশিষ্ট এ স্থানটিতে সম্ভবত নীল প্রক্রিয়াজাত করা হত।
স্টাফ মেস/কোয়াটার: স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় ১০০মিটার উত্তর দিকে ১টি পরিত্যক্ত স্থাপনা রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একতলাবিশিষ্ট এ দালানটি আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। ২২মিটার দীর্ঘ ও ১১মিটার প্রস্থবিশিষ্ট এ স্থাপনাটি নীলকুঠির স্টাফ মেস/কোয়াটার হিসেবে পরিচিত। এ স্থাপনার সামনে ও পিছনে ২.১০মিটার প্রস্থবিশিষ্ট বারান্দা রয়েছে। আবার অনেকের কাছে এ স্থাপনাটি নীলকুঠির কাচারি হিসেবে পরিচিত। এ স্থাপনাটি পূর্ব-পশ্চিমে মাঝ বরাবর দেয়াল দিয়ে বিভক্ত। স্থাপনাটি উত্তর ও দক্ষিণাংশে ৫টি করে সর্বমোট ১০টি কক্ষ রয়েছে। স্থাপনাটি নির্মাণে ইট ও চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। স্থাপনাটির দরজা ও জানালায় সেগমেণ্টাল খিলানের প্রতিফলন দেখা যায়। ছাদ তৈরিতে লোহা ও কাঠের বর্গা এবং টালি ব্যবহৃত হয়েছে।
রেকর্ডরুম: স্টাফ মেস/কোয়াটার থেকে প্রায় ১০মিটার উত্তর দিকে আরও ১টি পরিত্যক্ত স্থাপনা রয়েছে। এ স্থাপনাটি রেকর্ডরুম হিসেবে পরিচিত। এ স্থাপনাটি আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় এবং পূর্বমুখী করে নির্মিত। এ স্থাপনাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৯ মিটার। এ স্থাপনার প্রায় বিধ্বস্ত বারান্দার সামনের দেয়ালে সেগমেন্টাল খিলানের তোরণ রয়েছে। বারান্দা থেকে রেকর্ডরুমের কক্ষগুলোতে প্রবেশের জন্য সেগমেন্টাল ও সমতলখিলানের একাধিক প্রবেশপথ রয়েছে। স্থাপনাটির ছাদে কাঠ ও লোহার বর্গা এবং টালির ব্যবহার দেখা যায়।
তেলের পাম্প: রেকর্ডরুম থেকে প্রায় ৫মিটার পূর্ব দিকে ১টি স্থাপনা দেখা যায়। অর্ধবৃত্তাকারের এ স্থাপনাটি তেলের পাম্প হিসেবে পরিচিত। ইটের তৈরি এ স্থাপনাটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৩মিটার দীর্ঘ এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১.৫মিটার প্রশ্বস্ত। সম্ভবত এ পাম্পটি জ্বালানী তেল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
নায়েব ঘর: রেকর্ডরুম থেকে প্রায় ১২মিটার উত্তর দিকে কথিত নায়েব ঘর নামক স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। এ স্থাপনার অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কেবল এর পাকা মেঝের অংশবিশেষসহ ১টি দেয়াল রয়েছে। ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এ দেয়ালটির সাথে সেগমেন্টাল খিলানের ৫টি প্রবেশপথ অবশিষ্ট রয়েছে। দেখে মনে হয়, এ দেয়ালটি নায়েব ঘরের মাঝের দেয়াল।
ঘোড়াশালা: নীলকুঠির মূল ভবন থেকে প্রায় ৫০মিটার উত্তর-পূর্ব কোণে পরিত্যক্ত ১টি স্থাপনা রয়েছে। জানা যায় যে, পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এ স্থাপনাটি ঘোড়াশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২৭ মিটার দীর্ঘ ও প্রস্থ ১০.৫ মিটার প্রস্তবিশিষ্ট এ স্থাপনার সামনে ও পশ্চিম পাশে বারান্দা রয়েছে। ইটের তৈরি এ স্থাপনাটির ছাদে টিন ও লোহার বীমের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
আমলাপাড়া: ঘোড়াশালা থেকে প্রায় ৫০মিটার পূর্ব দিকে কথিত আমলাপাড়া নামক স্থাপনাটি অবস্থিত। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এ স্থাপনাটি দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ মিটার ও প্রস্থ ৮ মিটার। এ স্থাপনাটি ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি। কথিত আছে, এ স্থাপনায় নীলকুঠির আমলাগণ বসবাস করতেন।
অন্যান্য স্থাপনা ও ধ্বংসাবশেষের ঢিবি: আমঝুপি নীলকুঠির বিশাল এলাকা জুড়ে আরও বেশ কিছু স্থাপনা দেখা যায়। এর মধ্যে ঘোড়াশালা ও আমলাপাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে ভগ্নপ্রায় কথিত মেস। ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি এ স্থাপনাটি একতলাবিশিষ্ট। নীলকুঠির মূল ভবনের সামনের পথ ধরে পূর্ব দিকে আমলাপাড়ায় যেতে ১টি কালভার্ট। এছাড়া এ নীলকুঠির এলাকায় তৎকালে নির্মিত এবং ব্যবহৃত একাধিক ইঁদারা (পাতকুয়া) রয়েছে। এছাড়া ঘোড়াশালা থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে ১টি প্রাচীন পুকুর রয়েছে। এছাড়া নীলকুঠির বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় সর্বমোট ৫টি মত ধ্বংসাশেষের ঢিবি দেখা যায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট | Historical Background |
আনুমানিক অষ্টাদশ – ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু সংখ্যক স্থাপত্যিক কাঠামোসহ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, ১৭৬৫ অব্দের পরে বঙ্গে কোম্পানী আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় নদীয়াসহ মেহেরপুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনভুক্ত হয়েছিল। ব্রিটিশরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের স্থায়ী ব্যবসায়িক এবং প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে থাকে। তাদের গড়ে তোলা কাঠামোগুলোর মধ্যে আমঝুপি নীলকুঠি অন্যতম। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ ঐতিহাসিক নীলকুঠি ইংরেজ কুঠিয়াল কেনি, সিম্পসেন, ফার্গুসেনের সতীর্থদের অত্যাচার আর শোষণের স্মৃতিবহন করে এখনও টিকে আছে। ব্রিটিশ শাসনের পরে মেদিনীপুরের জমিদার এ কুঠিবাড়ির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৫১ তারিখে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে আমঝুপি নীলকুঠি বাড়ির দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসন।১ ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট অনুসারে মেহেরপুর জেলার আমঝুপি নীলকুঠি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি, যা বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভূক্ত ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
লেখক: মো. শাহীন আলম |
তথ্যসূত্র :
১. আযম তোজাম্মেল, মেহেরপুর জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ( ঢাকা : গতিধারা, ফেব্রুয়ারী ২০০৯), পৃষ্ঠা ১৪, ১৫, ৭৭ ও ১৩৭।
২. মেহেরপুর জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন, ২০১৭, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩৩ – ৩৭।
৩. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।