ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব

১৯১২ অব্দে আলফ্রেড ওয়েগনার [Alfred Wegener] পৃথিবীর মহাদেশসমূহ সঞ্চালন সম্পর্কে তাঁর ‘Die Entstehung der Kontinente und Ozeane’ নামক গবেষণামূলক প্রবন্ধে যুক্তি সহকারে একটি তত্ত্ব বা মতবাদ উপস্থাপন করেন। যা মহীসঞ্চরণ তত্ত্ব নামেও সুপরিচিত। নিম্নে জার্মান ভূ-বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনারের মহাদেশীয় ভূ-ভাগ সঞ্চালনের উপরে তাঁর প্রদত্ত তত্ত্ব বা মতবাদটি তুলে ধরা হল। 

মহাদেশ সঞ্চালন মতবাদ [Continental Drift Theory]: এডওয়ার্ড স্যাস [Eduard Suess] এর প্রদত্ত মতবাদের ভূ-অভ্যন্তরের শ্রেণীবিভাগ অনুসারে ওয়েগনার তাঁর মতবাদের ধারণা ও মূল উপাদানগুলাে গ্রহণ করেন। ওয়েগনারের মতে, আদি প্যালিওজোইক (Paleozoic) যুগে (প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে) পৃথিবীতে প্যাঞ্জিরা বা প্যানজিয়া (Pangea) নামক সিয়াল বা SiAl (Silicone & Aluminum) গঠিত সংঘবদ্ধ একটি বৃহৎ মহাদেশীয় ভূ-ভাগ (চিত্র-১) ছিল।

প্যাঞ্জিরা বা প্যানজিয়া (Pangea)
চিত্র-১: প্যানজিয়া (Pangea)।

তখন ঐ সংঘবদ্ধ ভূ-ভাগের চারিদিক ঘিরে প্রােটোপ্রশান্ত মহাসাগর (Proto pacific Ocean) অবস্থিত ছিল। প্রােটোপ্রশান্ত মহাসাগরটি অবস্থান ছিল সিমা বা SiMa (Silicone & Magnesium) গঠিত অভ্যন্তরীণ স্তর বা নিম্ন স্তরের মহাদেশীয় ভূ-ভাগের উপরে (চিত্র-২ এর মত)। আর প্যালিওজোইক যুগে টেথিস সাগর গন্ডোয়ানা (Gondwana) নামক দক্ষিণের ভূ-খন্ড থেকে লরেশিয়া (Laurasia) নামক উত্তরের ভূখন্ডটিকে পৃথক করেছিল (চিত্র-৩)।

সিয়াল ও সিমা স্তর
চিত্র-২: সিয়াল গঠিত মহাদেশ, সাগর/মহাসাগর ও সিমা স্তরের অবস্থান।

তবে প্যালিওজোইক যুগের কার্বনিফেরাস কালের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। এ কারণেই ওয়েগনার সে সময়কার ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনাও করেননি। তাঁর মতে, পৃথিবীর বর্তমান প্রকৃত অবয়বগুলাের গঠন শুরু হয়েছিল কার্বনিফেরাস কাল (প্রায় ২৮ কোটি বছর আগে) থেকে। ঐ সময় থেকে মহাদেশীয় ভূখন্ডগুলাে দুই দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে (চিত্র-৩)। অর্থাৎ ভূ-খণ্ডগুলো (১) নিরক্ষরেখার দিকে এবং (২)পশ্চিম দিকে প্রবাহিত বা সরে যেতে থাকে। 

মহাদেশ সঞ্চালন
চিত্র-৩: প্যানজিয়া থেকে ধীরে ধীরে মহাদেশসমূহের সঞ্চালন।

মহাদেশ সঞ্চালনের চালিকা শক্তি [Driving Force of Continental Drift]: বিশেষ আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে প্যানজিয়া (Pangea) নামক সিয়াল বা SiAl ভূ-খন্ডটি টুকরাে টুকরো হয়ে অভ্যন্তরীণ স্তর বা নিম্ন স্তরের সিমা বা SiMa এর উপর দিয়ে প্রবাহিত বা সঞ্চালিত হতে শুরু করে। ওয়েগনারের মতে, ২টি শক্তির প্রভাবে এরূপ সঞ্চালনের ঘটেছিল। এগুলো হল –

প্রথমত: চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণজনিত তারতম্যের ফলে জোয়ার তরঙ্গের প্রভাবে ভূ-খণ্ডগুলোর কিছু পশ্চিম দিকে সঞ্চালিত বা প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ এ পশ্চিমাভিমুখী গতির প্রভাবের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা বর্তমান স্থানে এসে পৌঁছেছে।

দ্বিতীয়ত: কার্বনিফেরাস যুগে পৃথিবীর নিরক্ষীয় স্ফীতির ফলে সৃষ্ট মধ্যাকর্ষণের প্রভাবে অন্যান্য ভূখন্ডগুলাে নিরক্ষরেখার দিকে সঞ্চালিত বা প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ নিরক্ষরেখাভিমুখী গতির প্রভাবের ফলে আফ্রিকা, ভারতীয় উপদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরােপ বর্তমান স্থানে এসে পৌঁছেছে।

মহাদেশ সঞ্চালনের গতির উৎস [Speed Source of Continental Drift]: যখন কোন খণ্ড পদার্থ (a) অপর কোন পদার্থের (b) উপর ভাসতে থাকে, তখন ঐ খণ্ডটিতে (a) আকর্ষণ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয় এবং যে পদার্থের (b) উপর খণ্ডটি (a) ভাসতে থাকে তাতে (b) চাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। এ চাপ কেন্দ্রকে প্লবতা কেন্দ্র বলে। সিয়াল বা SiAl খণ্ডের গতি নির্ভর করে ভাসমান বস্তুটির অভিকর্ষ কেন্দ্রের আবর্তনের উপরে। যদি ভাসমান বস্তুটি সমজাতীয় হয় কিন্তু ঘূর্ণায়মান না হয়, তাহলে অভিকর্ষ কেন্দ্র এবং প্লবতা কেন্দ্র একে অপরকে আচ্ছাদন করে। তবে পৃথিবী উপবৃত্তাকার এবং আকর্ষণশীল হওয়ায় অভিকর্ষ কেন্দ্রপ্লবতা কেন্দ্র পরস্পরকে আচ্ছাদন করে না। বরং একে অপর থেকে দূরে অবস্থান করে। যার ফলে সিয়াল বা SiAl স্তর নিরক্ষরেখার দিকে প্রবাহিত হবার প্রবণতা লাভ করে।

অপরদিকে চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ পৃথিবীর সিয়াল বা SiAl গঠিত বহিরাবরণ ভূ-ত্বককে অভ্যন্তরীণ স্তর সিমা বা SiMa এর উপর দিয়ে পশ্চিম দিকে চালিত করে। প্যালিওজোইক (Paleozoic) ও মেসােজোইক (Mesozoic) যুগে সিমা স্তরটি নমনীয় থাকায় সহজেই সিয়াল জোয়ারী শক্তির প্রভাবে সঞ্চালিত বা প্রবাহিত হয়েছিল।

মহাদেশ সঞ্চালন মতবাদে মেরু বিন্দুর স্থানান্তর [Pole Point Shifting in Continental Drift Theory]: ওয়েগনার তাঁর মতবাদে মহাদেশীয় ভূ-খণ্ডগুলোর সঞ্চালন বা প্রবাহের সাথে সাথে মেরু বিন্দু ২টির স্থানান্তরিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ মতবাদ অনুসারে, প্যালিওজোইক যুগের সিলুরিয়ান (Silurian) উপযুগে (প্রায় ৩৪ কোটি বছর আগে) উত্তর মেরু (north pole) ১৪° উত্তর অক্ষরেখা ও ১২৪° পশ্চিম দ্রাঘিমারেখার ছেদবিন্দুত অবস্থান করে ছিল। অপরদিকে তখন দক্ষিণ মেরুর (south pole) অবস্থান ছিল বর্তমান মাদাগাস্কারের দক্ষিণ-পশ্চিমে। উত্তর মেরু কার্বনিফেরাস (Carboniferous) উপযুগে (প্রায় ২৮ কোটি বছর আগে) ১৬° উত্তর অক্ষরেখা ও ১৪৭° পশ্চিম দ্রাঘিমারেখার ছেদ বিন্দুতে অবস্থান করে ছিল। অপর দিকে তখন দক্ষিণ মেরু অবস্থান ছিল নাটালের ডারবান সন্নিকটে। আর সেনোজোয়িক (Cenozoic) যুগের টারশিয়ারী (tertiary) উপযুগে (প্রায় ৭ কোটি বছর আগে) উত্তর মেরু ৫১° উত্তর অক্ষরেখা ও ১৫৩° পশ্চিম দ্রাঘিমারেখার ছেদবিন্দুতে অবস্থান করে ছিল। অপরদিকে তখন দক্ষিণ মেরুর অবস্থান ছিল আফ্রিকার দক্ষিণে ৫৩° দক্ষিণ অক্ষরেখার সন্নিকটে। ওয়েগনার বক্তব্য অনুসারে, অনুরূপভাবে নিরক্ষরেখার অবস্থান পরিবর্বিত হয়েছিল।

আলফ্রেড ওয়েগনারের প্রদত্ত মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব (continental drift theory) নিয়ে ভূ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য ও সমালোচনা হয়েছে। কোন কোন ভূ-বিজ্ঞানী মনে করেন, সিমা স্তরের উপর দিয়ে সিয়াল গঠিত মহাদেশসমূহের সঞ্চালন সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটি পুরোপুরো যৌক্তিকতাসহ ওয়েগনার উপস্থাপন করতে পারেননি। তিনি মহাদেশ সঞ্চালন গতির উৎস ও পৃথিবীর মেরু বিন্দুদ্বয়ের অবস্থান পরিবর্তন বা স্থানান্তর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। মতপার্থক্য ও সমালোচনা হলেও প্লেট টেকটনিক নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বর্তমান বিজ্ঞানীদেরকে ওয়েগনারের তত্ত্বটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতে পেরে ছিল। বিভিন্ন মহাদেশের ভূতাত্ত্বিক নমুনা, সাংস্কৃতিক নিদর্শন এবং প্রাণি ও উদ্ভিদের জীবাশ্ম নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মহাদেশ স্থানান্তরিত হওয়ার স্বপক্ষে এখন অনেক যৌক্তিকতাই খুঁজে পাওয়া যায়। আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো কোন এক সময় বিক্ষিপ্ত মহাদেশসমূহ পুনরায় একটি স্থানে প্যানজিয়ার মত সংঘবদ্ধ হতে পারে। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা ও ছবি:
১। Singh, Savindra, Physical Geography, 2009, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India, Page 58-65
২। Continental drift

৩। প্যানজিয়া
৪। brainly.in 
৫। Expanding Earth


Click for Watching:



Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *