কলম্বাসের অভিযানে মুসলিম মনীষীদের অবদান (প্রথম পর্ব)
সময়টা ১৪৯২ এর বেশ কবছর আগের। কলম্বাসের চিন্তা ভাবনার অনেক আগেই ভাস্কো দা গামা ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছানোর নিমিত্তে আরবীয় নাবিক আহমদ ইবনে নাফিসের প্রণীত মানচিত্র মোতাবেক তার গাইড হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল অতিক্রম করে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান। কিন্তু এই মানচিত্র সম্পর্কে কোন ধারণা তখন ইউরোপের কোন নাবিকদের ছিল না। অথচ এ সকল তথ্য কলম্বাসের থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের অপর প্রান্তে পৌঁছানোর হিসাব বের করতে অপারগতা পরিচয় দেন।
পৃথিবীকে ৩৬০ ডিগ্রীতে ভাগ করলে ১ ডিগ্রী দূরত্ব কত সে বিষয়ে তারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। বর্তমান বিশ্ব এ বিষয়ে অবগত যে ১° সমান ১১১ কি.মি. বা ৬০ নটিক্যাল মাইল। ইরোটোসথেনিস (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক) হিসাবটির অত্যন্ত নিকটবর্তী অবস্থানে ছিলেন। তিনি প্রকৃত ব্যবধান ১ কি.মি. বা ৫৯৫.৫ নটিক্যাল মাইল বলে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে নবম শতকের মুসলিম জ্যোতির্বিদ আবু al-abbas আহমদ ফারগানী প্রতি ডিগ্রির ব্যবধান ১২২ কি.মি. নির্ধারণ করেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার জ্যোতির্বিদ প্রতি ১° এর ব্যবধান করেন ৯৩ কি.মি. বা ৫০ নটিক্যাল মাইল। কলম্বাস এ প্রেক্ষাপটে আল ফারগানীর হিসাবকে রোমান মাইলে রূপান্তর করেন। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য পোর্টেলেসির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কলম্বাসের সময়ে আরবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়। এ সবের প্রায় সবকিছুই স্পেন ও পর্তুগালের গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত ছিল।আল-বিরুনী অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করেন এবং তার প্রায় ৬০০ বছর আগে পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ঘুরতো বলে গ্যালিলিও মত প্রকাশ করেন। তার এক বছর পর নবম শতকে আরব আল খাওয়ারিজমী পৃথিবীর দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করেন এবং আরব নাবিকগণ এর ভিত্তিতে পরিমাপ করে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। ঠিক একই সময়ে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ইবনে ইউনুস ও আল-বাত্তানী সেক্সটান্ট এবং কম্পাস বাদ্যযন্ত্রের উন্নতি সাধন করেন। তার কয়েকশত বছরের মধ্যে এ গুলোর সাহায্য ব্যতীত কেউ দূর সমুদ্রের যাত্রা করার স্পর্ধা দেখান নাই। অন্তত ইতিহাসে তার নজির নেই। ওদিকে দ্বাদশ শতকে আল ইদ্রিসি তার কয়েক খণ্ডে সমাপ্ত সংকলনকৃত বিশ্ব মানচিত্র সংকলনে অসংখ্য মানচিত্র এবং চাট সংযোজন করেন।
দূরত্ব পরিমাপ সমাপ্ত হলে কলম্বাস ভারত ও প্রাচ্যে পৌঁছবার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। কিন্তু আরব ও মুসলিম উৎসসমূহ কলম্বাসের সন্দেহপ্রবণ মনকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। ফলে তিনি ফ্লোরেনটাইনের অখ্যাত চিকিৎসক টনসেনিসের মতবাদকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অভিযাত্রায় টনসেনিসের চাট সঙ্গে নেন।কলম্বাস মনে করতেন স্পেন থেকে পশ্চিম হয়ে ভারতযাত্রা যথেষ্ট বিপদসংকুল। তবে পথটা সংক্ষিপ্ত। ফলে মার্টিন বেহাইস (পেটোলেসি এবং জার্মান মানচিত্র প্রণেতা) এর পরিমাণ ও মানচিত্রকে ভিত্তি করে কলম্বাস চার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চীনে গমন করতে পারবেন বলে এমন একটা ধারণা তার মধ্যে জন্মলাভ করে। পিয়েরে দা এইলি রচিত পুস্তকে এর সমর্থন করা হয়েছে। এছাড়া কলম্বাসের পুত্র ও তার জীবনীকার গারতি উল্লেখ করেন যে এই পুস্তকটি প্রায়ই তার বিছানায় পড়ে থাকত।
দ্য এইলি এর মধ্যে বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল যে পশ্চিম মহাসাগর অর্থাৎ মরক্কো এবং এশিয়ান পূর্ব উপকূলের মধ্যে যাতায়াত স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প পরিশ্রমে সম্পন্ন করা সম্ভব।তিনি দ্বিতীয় শতকের গ্রিক মানচিত্র মেরিনাস অফ টাওয়ারের অনুসরণ করতেন যাতে আটলান্টিক মহাসাগরকে অত্যন্ত সরু করে দেখানো হয়েছে। অথচ ইউরেশিয়ার পূর্ব এবং পশ্চিম এর মধ্যে অত্যন্ত প্রশস্ততা দেখানো হয়েছে। এই ভুল হিসাব অনুসরণ করতে গিয়ে কলম্বাস এরূপ ধারণা পোষণ করতেন যে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া হয়তো খুব বেশি সমস্যাসঙ্কুল হবে না। কিন্তু বাস্তবে এই ভুল হিসাব এর দরুন তাকে নানা বিপদের হতে হয়। সবকিছু বিবেচনা করে এটা অনুমিত হয় যে তিনি ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ এবং বাহামার মধ্যবর্তী মহাসাগর অতিক্রম করেন কেবল দিকদর্শন যন্ত্র,ডিভাইডার স্কোয়াড্রন এবং লীড লাইন দিয়ে। তিনি যে দিকদর্শন যন্ত্র সঙ্গে দিয়েছিলেন তা প্রায় চারশত বছর পূর্বে আরব বণিকরা ব্যবহার করতেন। আর স্কোয়াড্রন এর আবিষ্কারক ছিলেন আরব বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস। এভাবেই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সত্ত্বেও কলম্বাস শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের প্রণীত মানচিত্র এবং মুসলমানদের প্রবর্তিত দিকদর্শন যন্ত্র স্কোয়াড্রন নিয়েই সমুদ্রযাত্রা করেন। এবিষয়ে সর্বপ্রথম তথ্য তুলে ধরেন বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক ওয়াশিংটন আর্ভিং (Washington Irving) তার Life of Columbus নামক গ্রন্থে ।১৮৮২ সালের পরবর্তীতে লন্ডনে প্রকাশিত” The first America to Discover Islam” এর মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে ইউরোপীয়দের কাছে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে কলম্বাস তার ঐতিহাসিক অভিযাত্রায় বেশ কয়েকটি উন্নতমানের কম্পাস ব্যবহার করেন।ওয়াল্ড বুক অফ এনসাইক্লোপিডিয়া এর বর্ণনা অনুযায়ী ক্রিস্টোফার কলম্বাস ব্যবহৃত তিনটি জাহাজেই এই উন্নতমানের কম্পাস ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে নৌচালনার ক্ষেত্রে কম্পাস বা দিকনির্ণয় যন্ত্রের ব্যবহার মুসলমানরাই প্রবর্তন করেন। Magnetic needle এর প্রথম উল্লেখ চিনা জ্যোতির্বিদ গণিতজ্ঞ শেন-কুয়া এর গ্রন্থে সন্নিবেশিত হলেও নৌচালনার ক্ষেত্রে,কম্পাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরব মুসলমানরাই পথিকৃৎ।Robert Brifold তার “দা মেকিং অফ হিউমিনিস্ট”(লন্ডন ১৯১৯ পৃষ্ঠা ২০৬) গ্রন্থে এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ করেন যে ইউরোপীয়রা কম্পাস এর কথা জানতে পারে আরবদের মাধ্যমে।আজকের ইংরেজ সম্প্রদায় যদি বিষয়টি বিস্মৃত হয়ে থাকেন তবে তাদের পূর্বপুরুষ রবার্ট ব্রিফোল্ড এর গ্রন্থটি তারা পুনরায় পড়ে নিতে পারেন। এতে করে তাদের শুদ্ধ ইতিহাসচর্চার পথ সুগম হতে পারে। মুসলমানদের দ্বারা প্রবর্তিত তিনটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার (কম্পাস, বারুদ, কাগজ) কলম্বাস তার অভিযাত্রায় কৃতিত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। স্পেনে মুসলমানদের যখন ফার্দিনান্দ, ইসাবেলা বিতারণ করে দেন তখন মুসলমানদের তাদের ঐতিহ্যময় জ্ঞান সম্পদ পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে। [ড. আহমেদ আবদুল্লাহ]