গুহা ও গুহার শ্রেণিবিভাগ
গুহা [Cave] শব্দের আভিধানিক অর্থ হল গহ্বর, পর্বতকন্দর, ইত্যাদি। গুহা শব্দের আলংকারিক অর্থ হল গুপ্ত স্থান, নির্ভৃত স্থান, অন্তরতম প্রদেশ, ইত্যাদি। মূলতঃ গুহা হল ভূ-গর্ভে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ফাঁপা বা ফাঁকা (void) অংশবিশেষ। গুহাবিদ্যা (speleology) অনুসারে, গুহা বলতে ভূ-অভ্যন্তরে অবস্থিত ফাঁপা অংশকে বুঝায়, যা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এবং মানুষ প্রবেশ করার জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ – বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা ভিয়েতনামের কোং বিন প্রদেশের বো টাচ জেলায় অবস্থিত হ্যাংসন ডুং, ভারতের অজন্তা ইলোরা গুহা, বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত আলুটিলা গুহা, ইত্যাদির নামক গুহা উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়ামকের প্রভাবে ভূ-গর্ভে গুহার সৃষ্টি হয়ে থাকে। সাধারণত ভূ-গর্ভস্থ পানির ক্ষয়কার্যের ফলে চুনাপাথর অঞ্চলে স্থলভাগে গুহা সৃষ্টি হয়ে থাকে। আবার, পানির ঢেউয়ের ক্ষয়কার্যের ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী পাহাড়ের তলদেশে বা পাহাড়ের পাদদেশে ফাঁপা (void) সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমুদ্র উপকূলে সৃষ্ট এরূপ ফাঁপা বা গহ্বরকে সামুদ্রিক গুহা বলা হয়।
গুহার প্রকারভেদ: ভিন্ন ভিন্ন ধরনের গুহার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকে। গঠনের বৈচিত্র্যতার জন্য গুহাকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। আর গুহার শ্রেণিবিন্যাসের জন্য বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়, যা গুহার বিভিন্ন শ্রেণি বা ধরন প্রদান করে। এখানে সবচেয়ে সাধারণ শ্রেণিবিভাগ উপস্থাপন করা হয়েছে।
১. শিলা অনুসারে গুহার প্রকারভেদ: শিলা অনুসারে গুহাকে কতিপয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হল:
১.১. কার্বনেটস গুহা (carbonates cave): কার্বনেটসবিশিষ্ট ভূ-গর্ভে এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গুহাকে চুন পাথরের গুহাও বলা হয়। এ ধরনের গুহায় চুন, ডলোমাইট, মার্বেল, বালি-চুনা পাথর, ইত্যাদির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
১.২. সালফেটস গুহা (sulfates cave): সালফেটসবিশিষ্ট ভূ-গর্ভে এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গুহাকে জিপসাম (gypsum) গুহাও বলা হয়।
১.৩. হ্যালাইডস গুহা (halides cave): হ্যালাইডসবিশিষ্ট ভূ-গর্ভে এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গুহাকে লবণের (salt) গুহাও বলা হয়।
১.৪. আগ্নেয়গিরির শিলার (volcanic rocks) গুহা: আগ্নেয়গিরির শিলার ভূ-গর্ভে এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গুহাকে লাভা (lava) গুহাও বলা হয়।
১.৫. বেলেপাথরের (volcanic rocks) গুহা: বেলেপাথরের ভূ-গর্ভে এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়।
১.৬.স্ফটিকময় শিলার (crystalline rock) গুহা: স্ফটিকময় শিলাবিশিষ্ট ভূ-গর্ভে এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়।
২. অঙ্গসংস্থান অনুসারে গুহার প্রকারভেদ: জ্যামিতিক গঠন বা অঙ্গসংস্থান (morphology) অনুসারে গুহাকে কতিপয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হল:
২.১. আনুভূমিক গুহা (horizontal cave): ভূ-গর্ভে সৃষ্ট গুহায় আনুভূমিক গলি বা বারান্দার মত থাকে। তাই এরূপ গুহাকে আনুভূমিক গুহা বলা হয়।
২.২. ফাটল গুহা (cleft cave): ভূ-গর্ভে পাথরের ফাঁক (gap) দিয়ে গঠিত। তাই এ ধরনের গুহাকে ফাটল গুহা বলা হয়।
২.৩. উল্লম্ব গুহা (vertical cave): ভূ-গর্ভে সৃষ্ট পাথরের গুহায় ছোট করিডোর সংযুক্ত উল্লম্ব খাদের মত থাকে। এ ধরনের গুহাকে খাদ গুহাও (shaft cave) বলা হয়।
২.৪. গুহা প্রণালী (cave system): ভূ-গর্ভে সৃষ্ট এ ধরনের গুহা বেশ বড় হয়। একই সাথে আনুভূমিক ও উল্লম্ব খাদ উভয়ই থাকে।
৩. শিলা গঠনের সময় অনুসারে: আশেপাশের শিলা গঠনের সাথে গুহার শিলার গঠনের সময় অনুসারে গুহাকে কতিপয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হল:
৩.১. প্রাথমিক গুহা (primary cave): প্রাথমিক গুহা (primary cave) সাধারণত পাথর গঠনের প্রথম পর্যায়ে বা সময়ে একই সাথে তৈরি হয়।
৩.২. দ্বিতীয় পর্যায়ের গুহা (secondary cave): বেশিরভাগ গুহাই দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত গুহা হয়ে থাকে। শিলা গঠনের পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে (second phase) এ ধরনের গুহাগুলো সৃষ্টি হয়। সাধারণত, রাসায়নিক বা ভৌত প্রক্রিয়ায় ভূ-গর্ভের শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত এবং অপসারিত হয়ে এ পর্যায়ে গুহার সৃষ্টি হয়।
৩.৩. তৃতীয় পর্যায়ের গুহা (tertiary cave): সাধারণত অন্যান্য গুহা বা কৃত্রিম গহ্বরগুলোর পতনের ফলে তৃতীয় পর্যায়ের গুহার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গুহাগুলো প্রাথমিক গুহা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের গুহাগুলো পতনের ফলের সৃষ্টি হতে পারে। তৃতীয় পর্যায়ের গুহাকে ইংরেজিতে টারশিয়ারি গুহা (tertiary cave) বলা হয়। উপরের শ্রেণিবিভাগগুলো ব্যতিত গুহাকে আরও বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।
৪. গঠনের ধরন অনুসারে: গঠনের ধরন অনুসারে গুহাকে কতিপয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হল:
৪.১. দ্রবণীয় গুহা (solution cave): লবণ এবং জিপসামবিশিষ্ট গুহাগুলোর গঠনের জন্য শুধু পানির প্রয়োজন হয়। কারণ উভয়েরই বিশুদ্ধ জলে খুব উচ্চ দ্রবণীয়তা রয়েছে। যা ভূ-গর্ভে এ ধরনের (দ্রবণীয়) গুহা সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪.২. কার্স্ট গুহা (karst cave): চুনাপাথর এবং ডলোমাইট শিলাবিশিষ্ট গুহার ক্ষেত্রে, এসব শিলা খুব দুর্বল প্রাকৃতিক অ্যাসিড (সাধারণত কার্বনিক অ্যাসিড) দ্বারা দ্রবীভূত হয়। বায়ু এবং মাটি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) শোষণ করে স্বাভাবিক বৃষ্টির পানি থেকে এ অ্যাসিড অনিবার্যভাবে গঠিত হয়। এরূপ ভাবে ভূ-গর্ভে এ ধরনের (কার্স্ট) গুহা সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪.৩. লাভা গুহা (lava cave): লাভা, অর্থাৎ গলিত শিলা ঠান্ডা হয়ে লাভা গুহা তৈরি হয়। লাভা ঠাণ্ডা অবস্থায় এবং দৃঢ় হয়ে যাওয়ার আগে এ ধরনের (লাভা) গুহাগুলো তৈরি হয়ে থাকে।
৪.৪. ক্ষয়কারী গুহা (erosion cave): যান্ত্রিক আবহবিকার এবং জল বা বায়ু দ্বারা খনিজ উপাদান অপসারিত হলে সাধারণত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এ গুহাগুলো গঠিত হয়।
৪.৫. হিমবাহ গুহা (glacial cave): তাপে বরফ গলে এ ধরনের গুহা তৈরি হয়, যা সাথে করে প্রচুর পানি বহন করে নিয়ে আসে। গলিত পানি হিমবাহের গেইট দিয়ে প্রবেশ করে হিমবাহ গুহা ও উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে।
৪.৬. টেকটোনিক গুহা (tectonic cave): বিভিন্ন ধরনের টেকটোনিক গুহা রয়েছে। এগুলো হল:
৪.৬.১. গুহা (cave): বড় ভূমিধস স্ক্রি (scree) ঢাল তৈরি করে। কখনও কখনও বেশ বড় পাথরের মধ্যে বড় গহ্বর (গুহা) তৈরি হতে পারে।
৪.৬.২. ফাটল গুহা (fractured cave): উপত্যকার ঢালে এবং স্তরে, উপরের স্তরের ধসের কারণে এ স্তরটি (উপরের) নীচের স্তরের উপরে পিছলে পড়ে ক্ষয়ের সৃষ্টি করে। এটি সম্প্রসারণ ফাঁক বা ফাটল তৈরি করে।
৪.৬.৩. নিওটেকটোনিক গুহা (neotectonic cave): টেকটোনিক গুহাগুলোর একটি বিশেষ রূপ, যা প্রায় একচেটিয়াভাবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় পাওয়া যায়। বরফ যুগের হিমবাহ গলানোর ফলে সৃষ্ট চাপ উপশমের সাথে সম্পর্কিত টেকটোনিক শক্তির দ্বারা এটি তৈরি করা হয়েছিল।
৪.৬.৪. অনুপ্রবেশের গহ্বর (cavity of incursion): এ ধরনের গুহা সাধারণত গহ্বরের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়।
৫. শিলার বয়স অনুসারে গুহা: এ শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে কার্স্ট গুহাগুলো (karst caves) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চুনাপাথরের মত পাললিক শিলা গঠিত হওয়ার সময়ে গুহার সৃষ্টি হয়। শিলা গঠিত হওয়ার বয়সকে ভিত্তি করে শিলার বয়স ভিত্তিক গুহার শ্রেণী বিভাগ করা হয়। যেহেতু কোন না কোন সময়ে চুনাপাথর সর্বদাই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও জমা হয়ে চলেছে। [মো: শাহীন আলম]
সহায়িকা:
১. speleology
২. বাকী, আবদুল, (২০১৩), ভুবনকোষ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা – ৮৪।
৩. গুহা, from Wikipedia, the free encyclopedia.
৪. Cave, from Wikipedia, the free encyclopedia.
image source: Painted Cave, a large sea cave, Santa Cruz Island, California
গুহা বলতে কি বুঝায় এবং গুহার শ্রেণিবিভাগ ?