থর্ণথওয়েটের বিশ্ব জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগ

সাধারণত ২টি ভিত্তি; যেমন – (ক) পরীক্ষামূলক (empirical) ভিত্তি এবং (খ) উদ্ভব সম্বন্ধীয় (genetic) ভিত্তির উপর বিশ্ব জলবায়ুকে কতিপয় নির্দিষ্ট ভাগে এবং উপভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জলবায়ু উপাদানগুলোর পরিসংখ্যানগত তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিশ্ব জলবায়ুর পরীক্ষামূলক (empirical) শ্রেণীবিভাগ করা হয়। অপরদিকে জলবায়ু ঘটনা (climatic phenomena) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণের উপর ভিত্তি করে উদ্ভব সম্বন্ধীয় (genetic) শ্রেণীবিভাগ করা হয়। যদিও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশ্ব জলবায়ুকে শ্রেণীবিভাগ করার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্য ধেকে ভ্লাদিমির কোপেন (Wladimir Koeppen), সি. ডব্লিউ. থর্ণথওয়েট (C. W. Thornthwaite), এবং জি. টি. ত্রেওয়ার্থ (G.T. Trewartha) -এর প্রদত্ত বিশ্ব জলবায়ু শ্রেণীবিভাগ বেশি ব্যবহৃত হয়।

সি. ডব্লিউ. থর্ণথওয়েট (C. W. Thornthwaite) একজন আমেরিকান জলবায়ুবিদ। ১৯৩১ সালে থর্ণথওয়েট প্রথমে উত্তর আমেরিকার জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগ উপস্থাপন করেন। তখন তিনি উত্তর আমেরিকার জলবায়ু মানচিত্র প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি তার জলবায়ু শ্রেণীবিভাগকে বিশ্ব জলবায়ু শ্রেণীবিভাগে প্রসারিত করেন এবং ১৯৩৩ সালে তার সম্পূর্ণ জলবায়ু শ্রেণীবিভাগ উপস্থাপন করেন। তিনি তার জলবায়ু শ্রেণীবিভাগটি আরও পরিবর্তন করেন এবং ১৯৪৮ সালে বিশ্ব জলবায়ু শ্রেণিবিন্যাসের দ্বিতীয় সংশোধিত রূপ উপস্থাপন করেন। তার এ জলবায়ু শ্রেণীবিভাগেটি জটিল এবং পরীক্ষামূলক (empirical) প্রকৃতির।

১৯৩১ সালের থর্ণথওয়েটের জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগ: কোপেনের মত থর্নথওয়েটও একটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক গাছপালাকে সে অঞ্চলের জলবায়ুর সূচক (indicator) হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি তার এ ধারণাটি গ্রহণ করেন যে, বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিমাণের উপর গাছপালার সর্বোত্তম নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে তিনি বাষ্পীভবনকে উদ্ভিদ এবং জলবায়ুর গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। এ কারণেই থর্নথওয়েট বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণের জন্য বৃষ্টিপাতের কার্যকারিতা (precipitation effectiveness) এবং তাপমাত্রার কার্যকারিতা (temperature effectiveness) এ ২টি নিয়ামককে ব্যবহার করেন।

(ক) বৃষ্টিপাতের কার্যকারিতা (precipitation effectiveness): ভ্লাদিমির কোপেনের জলবায়ুর শ্রেণী বিন্যাসের নীতির উপর ভিত্তি করে থর্ণথওয়েট তার শ্রেণী বিভাগ উপস্থাপন করেন। তিনি মাটি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং উদ্ভিদ পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন প্রকারের জলবায়ুকে শনাক্ত করেন। উদ্ভিদের ক্রমোবৃদ্ধিতে বৃষ্টিপাতের ভূমিকা নির্ণয় করার জন্য তিনি মোট মাসিক বৃষ্টিপাত এবং মোট মাসিক বাষ্পীভবনের অনুপাত নির্ণয় করেন। তার বৃষ্টিপাত এবং বাষ্পীভবনের এ অনুপাতকে P/E অনুপাত (P/E Ratio) বলে। এখানে, P মানে হল Precitation বা বৃষ্টিপাত এবং E মানে হল Evaporation বা বাষ্পীভবন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি কেন্দ্রের তুষারপাত, বাষ্পীভবন এবং তাপমাত্রার তথ্যের উপর ভিত্তি করে থর্ণথওয়েট P/E অনুপাতের যে সূত্র প্রস্তুত করেছেন, তা নিম্নে উল্লেখ করা হল।

থর্ণথওয়েট P/E Ratio = (r/t-10)10/9 এর উপরে ভিত্তি করে প্রথমে একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের জলবায়ুকে শ্রেণীবিভাগ করেন। পরবর্তীতে তিনি সমগ্র বিশ্বের জলবায়ুর শ্রেণী বিভাজনের জন্য P/E Ratio = (r/t-10)10/9 এ সূত্রটি ব্যবহার করেন। আর সূত্রটির উপরে ভিত্তি করে থর্নথওয়েট সমগ্র বিশ্বকে ৫টি আর্দ্রতা অঞ্চলে বিভক্ত করেন। এগুলো হল:

A  = বৃষ্টিবহুল অঞ্চল (Wet Zone),

B = আর্দ্র অঞ্চল (Humid Zone),

C = অর্ধ আর্দ্র অঞ্চল (Subhumid Zone),

D = অর্ধ শুষ্ক অঞ্চল (Semiarid Zone), এবং

E = শুষ্ক অঞ্চল (Arid Zone)।

থর্ণথওয়েটের বিভাজিত সমগ্র বিশ্বের ৫টি আর্দ্রতা অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও সূচকের মান নিম্নের সারণিতে উপস্থাপন করা হল।

আর্দ্র অঞ্চল (Humidity Zone) উদ্ভিদ (Vegetation) P/E Index
 A  = বৃষ্টিবহুল  (Wet) বৃষ্টিবহুল অরণ্য (Rain Forest)> ১২৭
 B = আর্দ্র (Humid)অরণ্য (Forest)৬৪ – ১২৭
 C = অর্ধ আর্দ্র (Subhumid)তৃণভূমি (Grassland)৩২ – ৬৩
 D = অর্ধ শুষ্ক অঞ্চল (Semiarid)স্টেপ (Steppe)১৬ – ৩১
 E = শুষ্ক অঞ্চল  (Arid)মরুভূমি (Desert)<১৬

 ঋতু-অনুযায়ী বৃষ্টিপাত বন্টনের ভিত্তিতে থর্ণথওয়েট প্রতিটি আর্দ্রতা অঞ্চলকে ২০টি উপ আর্দ্রতা অঞ্চলে (subhumidity zones) বিভক্ত করেছেন। এ বিভাগগুলো হল:

১. Ar৬. Bs১১. Cw১৬. Dd
২. As৭. Bw১২. Cd১৭. Er
৩. Aw৮. Bd১৩. Dr১৮. Es
৪. Ad৯. Cr১৪. Ds১৯. Ew
৫. Br১০. Cs১৫. Dw২০. Ed

এখানে, r = সকল ঋতুতে প্রচুর বৃষ্টিপাত

s = গ্রীষ্মকালে অপর্যাপ্ত বৃ্ষ্টিপাত

w = শীতকালে অপর্যাপ্ত বৃ্ষ্টিপাত ও

d = সকল ঋতুতে অপর্যাপ্ত বৃ্ষ্টিপাত।

থর্ণথওয়েটের জলবায়ুর শ্রেণীবিভািগ অনুসারে তাপ ও আর্দ্রতা অঞ্চল
চিত্র: থর্ণথওয়েটের জলবায়ুর শ্রেণীবিভািগ অনুসারে তাপ ও আর্দ্রতা অঞ্চল।

(খ) তাপমাত্রার কার্যকারিতা (temperature effectiveness): থর্ণথওয়েট বিশ্বাস করেন যে, উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে তাপমাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আর জলবায়ুর শ্রেণী নির্ধারণের জন্য বৃষ্টিপাতের মত উষ্ণতার গুরুত্বকে স্বীকার করতে হয়। এ কারণে থর্ণথওয়েট মাসিক উত্তাপ সক্ষমতার একটি অনুপাত উদ্ভাবন করেন। তার এ অনুপাতকে T/E অনুপাত (T/E Ratio) বলে আখ্যায়িত করেন। এখানে, T মানে হল Temperature বা বৃষ্টিপাত এবং E মানে হল Evaporation বা বাষ্পীভবন। T/E Index নির্ণয় করার জন্য থর্ণথওয়েটের সূত্রটি হলো I = (T-32)/4। এখানে,  T/E Index এ বলা হয়েছে যে, তুন্দ্রা অঞ্চলের মেরু প্রান্তে এ সূত্রের মান কমে গিয়ে শূন্য হয়।

সারণি: থর্ণথওয়েটের তাপমাত্রা অঞ্চল।

তাপমাত্রা অঞ্চল (temperature zones)T – E Index 
 A’  = উষ্ণ মণ্ডলীয়  (tropical)১২৭
 B’ = নাতিশীতোষ্ণ (mesothermal)৬৪ – ১২৭
 C’ = শীতপ্রধান (microthermal)৩২ – ৬৩
 D’ =  তৈগা (taiga)১৬ – ৩১
 E’ = তুন্দ্রা  (tunda)১ – ১৫
F’ = তুষার (frost)

এভাবে, বৃষ্টিপাতের কার্যকারিতা (precipitation effectiveness), তাপীয় দক্ষতা (thermal efficiency) এবং বৃষ্টিপাতের ঋতুগত বন্টনের ভিত্তিতে ১২০টি সম্ভাব্য সমন্বয় হতে পারে। তবে তিনি এ সমন্বয়ের উপর ভিত্তি করে সমগ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে  ৩২ ভাগে বিভক্ত করেছেন।

১. A A’ r৯. B C’ r১৭. C B’ d২৫. D B’ d
২. A B’ r১০. B C’ s১৮. C C’ r২৬. D C’ d
৩. A C’ r১১. C A’ r১৯. C C’ s২৭. E A’ d
৪. B A’ r১২. C A’ w২০. C C’ d২৮. E B’ d
৫. B A’ w১৩. C A’ d২১. D A’ w২৯. E C’ d
৬. B B’ r১৪. C B’ r২২. D A’ d৩০. D’ 
৭. B B’ w১৫. C B’ w২৩. D B’ w৩১. E’
৮. B B’ s১৬. C B’ s২৪. D B’ s৩২. F’

১৯৪৮ সালে থর্ণথওয়েটের জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগ: থর্ণথওয়েট তাঁর ১৯৩১ সালের জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগের কিছুটা পরিবর্তন করে ১৯৪৮ সালে নতুন একটি শ্রেণীবিভাগ উপস্থাপন করেন। তাঁর এ শ্রেণী বিভাগে তিনি বৃষ্টিপাত বা তুষার পাতের ঋতুগত বন্টন (Seasonal distribution of snowfall or precipitation), বৃষ্টিপাতের কার্যকারিতা (precipitation effectiveness) এবং তাপমাত্রার কার্যকারিতা (temperature effectiveness) এ তিনটি উপাদান ব্যবহার করেন। তবে এ শ্রেণীবিভিাগ করার ক্ষেত্রে এ তিনটি উপাদানকে তিনি ভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রতিমাসের বৃষ্টিপাত এবং প্রতিমাসের সম্ভাব্য বাষ্পীপ্রস্বেদনের (potential evapotranspiration) হিসেব করেন। বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটি থেকে এবং প্রস্বেদনের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে কতটুকু জলীয় পদার্থের অপচয় হয় তা তিনি এখানে বুঝান। ১২ ঘণ্টার দিন হিসেবে ৩০ দিনের মাসের জন্য থর্ণথওয়েটের সম্ভাব্য বাষ্পীপ্রস্বেদন নির্ণয় করার সূত্র হল:

PE (in cm) = 1.6 (10 t/ 1 ) a এখানে, PE সম্ভাব্য বাষ্পীপ্রস্বেদন (potential evapotranspiration)

I = বারমাসের (t/5)1.514 এর যোগফল।

a = I আরও জটিল ফাংশন (function) (0.67513 – 77.112 + 17.9201+492.390)x 10-6

এসব উৎপাদক খুব সহজে নির্ণয় করতে থর্ণথওয়েট একটি সারণি তৈরি করেন। থর্ণথওয়েট মাটিতে সঞ্চিত জলীয় পদার্থের পরিমাণের উপর নির্ভর করে এবং সম্ভাব্য বাষ্পীপ্রস্বেদনের (potential evapotranspiration = PE) পরিমাণ নির্ণয় করে মাসিক জলীয় পদার্থের উদ্বৃত্তি (surplus = S) বা ঘাটতি (deficit = D) হিসেব করেন। তিনি জলীয় পদার্থের সূচক (Moisture index; i.e. S বা D নির্ণয় করেন। আর এ জন্য থর্ণথওয়েট নিম্নের সূত্র প্রদান করেন।

Im = 100 (S – D)/PE অথবা 100 (r/PE = 1)

এখানে,  Im = আর্দ্রতা সূচক (moisture index)  এবং

r = বার্ষিক বৃষ্টিপাত (annual rainfall)

থর্ণথওয়েটের ১৯৪৮ সালের  সম্ভাব্য বাষ্পীপ্রস্বেদন (PE) এবং ১৯৫৫ সালের আর্দ্রতা সূচকের ভিত্তিতে জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগ নিম্নের সারণিতে তুলে ধরা হল:

আর্দ্রতার সূচক (Im)

জলবায়ুর শ্রেণী

PE

জলবায়ুর শ্রেণী

Cm

index

১০০ এর অধিক

অতি আর্দ্র অঞ্চল (A)

১১৪

> ৪৪.৯

উষ্ণ মণ্ডল

২০ – ১০০

আর্দ্র অঞ্চল (B1 – B4)

৫৭

১১৪

২২.৪

৪৪.৯

নাতিশীতোষ্ণ (B1 – B4)

০ – ২০

প্রায় আর্দ্র অঞ্চল (C2)

২৮.৭

৫৭

১১.২

২২.৪

শীত প্রধান (C1 – C2)

–    ৩৩ থেকে ০

প্রায় অর্ধশুষ্ক অঞ্চল (C1)

২৪.২

৫.৬

তুন্দ্রা (D)

– ৬৬ থেকে – ৩৩

অর্ধশুষ্ক অঞ্চল (D)

২৮.৭

১১.২

 

– ১০০ থেকে – ৬৭

শুষ্ক অঞ্চল (E)

< ১৪.২

< ৫.৬

তুষার (E)


সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahabad, Page 513 – 517.
২। মাহমুদ, কাজী আবুল, (২০০৩), ভূগোল কম্প্রিহেনসিভ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫০ – ১৫১।


সংকলক: মো: শাহীন আলম থর্ণওয়েটের জলবায়ু


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *