নাইট্রোজেন চক্র: নাইট্রোজেন চক্রে মানুষের প্রভাব এবং পরিবেশ দূষণ
নাইট্রোজেন ভৌত পরিবেশে ও জীব পরিবেশে বিভিন্ন যৌগরূপে বিরাজ করে। ভৌত পরিবেশের বায়ুমণ্ডলে গ্যাসীয় নাইট্রোজেন (N2) রূপে, অশ্মমণ্ডলের মাটিতে ও বারিমণ্ডলের সমুদ্রের পানিতে নাইট্রেট (NO3–) রূপে এবং জীব পরিবেশে প্রোটিন গঠনকারী ‘অ্যামাইনো এসিড’, বংশগতি বহনকারী বস্তু রাইবোনিউক্লিক এসিড (RNA) এবং ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (DNA) প্রভৃতি জৈব অণু রূপে নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। বায়ুমণ্ডলের মোট আয়তনের ৭৯ শতাংশ নাইট্রোজেন গ্যাস। বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন গ্যাসই হল জীবজগতের নাইট্রোজেনের মূল উৎস। নিম্নে নাইট্রোজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্রে মানুষের প্রভাব এবং পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তুলে ধরা হল।
নাইট্রোজেন চক্র (nitrogen cycle): সাধারণত ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে নাইট্রোজেনের চক্রাকার প্রবাহকে নাইট্রোজেন চক্র বলা হয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণী বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন গ্যাস গ্রহণ করতে পারে না। নাইট্রোজেন গ্যাস বিশেষ একটি প্রক্রিয়ায় নাইট্রেট (NO3–) এবং অ্যামোনিয়ায় (NH3) রূপান্তরিত হয়। উদ্ভিদ নাইট্রোজেনকে রূপান্তরিত নাইট্রেট এবং অ্যামোনিয়া হিসেবে গ্রহণ করে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রাণী খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। আবার, বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ থেকে নাইট্রোজেন গ্যাস আকারে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। উদ্ভিদ পুনরায় একই প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। এরূপে ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে নাইট্রোজেনের চক্রাকারের প্রবাহ চলতে থাকে।
নাইট্রোজেন চক্রের পদ্ধতি (the mechanism of nitrogen cycle): ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে নাইট্রোজেনের অন্তর্প্রবাহ এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে নাইট্রোজেনের বহির্প্রবাহের মাধ্যমে নাইট্রোজেন চক্র সম্পন্ন হয়। তাই নাইট্রোজেন চক্রের পদ্ধতিকে দুটি নাইট্রোজেন প্রবাহে ভাগ করে নিন্মে ব্যাখ্যা করা হল।
১. ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে নাইট্রোজেনের অন্তর্প্রবাহ: মাটি ও উদ্ভিদের মূলে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন গ্যাসকে উদ্ভিদের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে। মটর, শিম, আলফালফা প্রভৃতি Leguminasae উদ্ভিদ মূলের নডিউলে বাস করে Rhizobium নামক ব্যাকটেরিয়া। এ ব্যাকটেরিয়া বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন গ্যাসকে সরাসরি নাইট্রেটে (NO3–) রূপান্তরিত করে। এছাড়া মাটিতে বাস করে Azotobacter, Cyanobacteria এবং Clostridium নামক ব্যাকটেরিয়া। এ ব্যাকটেরিয়াগুলো বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন গ্যাসকে অ্যামোনিয়ায় (NH3) রূপান্তরিত করে। Nitrosomonas নামক ব্যাকটেরিয়া অ্যামোনিয়াকে নাইট্রাইটে (NO2–) রূপান্তরিত করে। পরবর্তীতে Nitrobacter নামক ব্যাকটেরিয়া নাইট্রাইটকে নাইট্রেটে (NO3–) রূপান্তরিত করে।
উদ্ভিদ নাইট্রেট (NO3–) গ্রহণের মাধ্যমে নাইট্রোজেন আত্মীকৃত করে। উদ্ভিদ আত্মীকৃত নাইট্রোজেন থেকে Protein, RNA এবং DNA জৈব অণু সংশ্লেষ করে। খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে তৃণভোজী প্রাণীতে এবং তৃণভোজী প্রাণী থেকে মাংসাশী প্রাণীর দেহে নাইট্রোজেন প্রবাহিত হয়।
চিত্র: নাইট্রোজেন চক্র।
২. জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে নাইট্রোজেনের বহির্প্রবাহ: সবাত ও অবাত ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রাণীর মল, মূত্র এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত দেহাবশেষে বিদ্যমান নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া উৎপাদন করে। পরবর্তীতে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অ্যামোনিয়া থেকে নাইট্রেট উৎপাদন করে। উৎপাদিত নাইট্রেটের কিছু অংশ উদ্ভিদ পুনরায় গ্রহণ করে। নাইট্রেট থেকে অবশিষ্ট অংশ নাইট্রোজেন গ্যাস রূপে বায়ুমণ্ডলে প্রবাহিত হয়।
বজ্রপাতজনিত বিদ্যুতায়নের সময় আলোক রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন (N2) গ্যাস নাইট্রেটে (NO3–) রূপান্তরিত হয়। এভাবে উৎপন্ন নাইট্রেট বৃষ্টির মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের মাটি ও সমুদ্রে অধ:ক্ষিপ্ত হয়। মাটি থেকে নাইট্রেটের অংশবিশেষ উদ্ভিদ গ্রহণ করে। অপরদিকে, মাটি ও সমুদ্রে আত্মীকৃত নাইট্রেট (NO3–) থেকে Pseudomonas এবং Paracoccus নামক denitrifying ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে প্রথমে নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) উৎপন্ন হয়। পরে নাইট্রোজেন (N2) গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে প্রবাহিত হয়।
উপর্যুক্ত বর্ণনা অনুযায়ী নাইট্রোজেন মৌল বিভিন্ন রূপে বায়ুমণ্ডল থেকে ভূ-পৃষ্ঠের মাটি ও সমুদ্রে, মাটি থেকে উদ্ভিদে, উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে এবং মাটি, সমুদ্র, উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে পুনরায় বায়মণ্ডলে প্রবাহের মাধ্যমে নাইট্রোজেন চক্র চলন্ত থাকে। নাইট্রোজেনের এ প্রাকৃতিক চক্র কখনও থেমে যায় না।
নাইট্রোজেন চক্রে মানুষের প্রভাব এবং পরিবেশ দূষণ: নাইট্রোজেন চক্র একটি চলন্ত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাকৃতিক নাইট্রোজেন চক্র ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য ভুট্টার মত কতিপয় দানাশস্যের চাষাবাদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া একই জমিতে বছরে একাধিক বার শস্য উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এসব শস্য মাটি থেকে প্রচুর নাইট্রোজেন শোষণ করে। ফলে জমির মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাটির এ নাইট্রোজেন ঘাটতি দূর করা প্রয়োজন হয়। লেগুমিনেসি উদ্ভিদ চাষাবাদের মাধ্যমে কিংবা জৈব নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করে মাটির নাইট্রোজেনের ঘাটতি পূরণ করা যায়। কিন্তু এ পদ্ধতিটির পরিবর্তে শিল্প পদ্ধতিতে নাইট্রোজেন ঘটিত রাসায়নিক সার (ইউরিয়া) উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত রাসায়নিক সার অপরিকল্পিতভাবে অধিক পরিমাণে জমির মাটিতে প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মাটিতে নাইট্রোজেনে পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রাকৃতিক নাইট্রোজেন চক্র বিঘ্নিত হয়। এছাড়া নাইট্রোজেন ঘটিত রাসায়নিক সার প্রয়োগের কারণে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রেট (NO3–) জমির মাটি থেকে খাল, পুকুর ও নদীর পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। [সংকলিত]
তথ্যসূত্র: ১. পাল, গৌতম, পরিবেশ ও দূষণ, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লি., কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৮।
সংকলক: মো. শাহীন আলম।
Now I understand the nitrogen cycle very well