পুরাকীর্তি জরিপ ও অনুসন্ধান পদ্ধতি এবং কৌশল
শত বছরের আগে মানুষ কর্তৃক নির্মিত ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তির প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি জরিপ ও অনুসন্ধানের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। পুরাকীর্তির এ জরিপ ও অনুসন্ধানের প্রারম্ভে একটি নির্দিষ্ট এলাকা এবং ঐতিহাসিক সময় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এরপর জরিপ ও অনুসন্ধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করতে হয়।
পুরাকীর্তি জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে সম্পাদিত হয়। নিচে এরূপ অনুসৃত চারটি প্রধান ধাপ সংক্ষিপ্ত বর্ণনাসহ উল্লেখ করা হল –
ক) জরিপ ও অনুসন্ধানপূর্ব গবেষণা:পুরাকীর্তি জরিপ ও অনুসন্ধানের পূর্বে গবেষণায় অনুসৃত পদ্ধতিসমূহ হল –
ক.১. গ্রন্থ পর্যালোচনা: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত ও প্রকাশিত গ্রন্থ, গবেষণা প্রবন্ধ, পত্রিকা, সাময়িকী ও ওয়েব পোর্টাল পর্যালোচনা করে জরিপ ও অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচিত এলাকা এবং ঐ এলাকার পুরাকীর্তির প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। সম্ভাব্য পুরাকীর্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
ক.২. মানচিত্র সংগ্রহ ও অধ্যয়ন: জরিপ ও অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচিত এলাকার বিভিন্ন ধরনের মানচিত্র সংগ্রহ করা হয়। এসব মানচিত্র থেকে ভূ-প্রকৃতি, নদ-নদী, মাটি, ভূমিরূপ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক বিন্যাস সম্পর্কিত অধ্যায়ন করে নির্বাচিত এলাকার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
ক.৩. লিখিত দলিল সংগ্রহ ও অধ্যয়ন: পুরাতন পত্রিকা, ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন লিখিত দলিল সংগ্রহ করে অধ্যায়ন ও পর্যালোচনা করা হয়।
ক.৪. কিংবদন্তী ও অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ: জরিপ ও অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচিত এলাকার পুরার্কীতি সম্পর্কিত প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তী ও অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়।
ক.৫. জাতিতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ: জরিপ ও অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচিত এলাকার জাতিতাত্ত্বিক বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়।
ক.৬. ব্যক্তিগত যোগাযোগ: ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করা হয়।
খ) মাঠকর্ম: জরিপ ও অনুসন্ধানপূর্ব গবেষণা শেষে জরিপ ও অনুসন্ধানের জন্য নির্বাচিত এলাকা সরেজমিনে পায়ে হেঁটে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এসময় স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। নির্ধারিত ফরমে এসব তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধ করা হয়। তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধের সময় চারটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়। এগুলো হল-
(১) প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তির অবস্থানিক তথ্য-উপাত্ত (যেমন- ভৌগোলিক অবস্থান, প্রশাসনিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জেলা ও উপজেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রভৃতি),
(২) প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তির ঐতিহাসিক পটভূমি,
(৩) প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তির বিস্তারিত বর্ণনা এবং
(৪) প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তির সাথে অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের ক্রস-চেকিং। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে –
খ.১. মতবিনিময়: স্থানীয় জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসনের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করা হয়।
খ.২. তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধকরণ: জরিপ ও অনুসন্ধানকালে তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধকরণের কাজ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক তথ্য-উপাত্ত লিখন, জিপিএস ডাটা সংগ্রহকরণ, ভূ-প্রাকৃতিক জরিপ ( ভূমিরূপ, জলাভূমি, নদী, পুকুর, হৃদ, বন্যা, মাটির রং , মাটির সংযুক্তি, মাটির বুনন প্রভৃতি), প্রয়োজনীয় নকশা অঙ্কন, আলোকচিত্র ধারণ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজ করা হয়।
খ.৩. যন্ত্রপাতির ব্যবহার: পুরাকীর্তির জরিপ ও অনুসন্ধানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিছু Hard এবং Soft যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এরূপ কতগুলো যন্ত্রপাতির নাম নিচে তুলে ধরা হল-
১. আর্কজিআইএস, ২. অটোক্যাড, ৩. এডোবি ইলাস্ট্রেটর, ৪. মাইক্রোসফ্ট অফিস, ৫. জিপিএস ডিভাইস, ৬. লেভেলিং মেশিন, ৭. গুগল আর্থ, ৮. সয়েল কালার চার্ট, ৯. কম্পাস, ১০. ক্যামেরা, ১১. পরিমাপকরণ ফিতা, ১২. কম্পিউটার, ১৩.স্কেল এবং অন্যান্য।
গ) মাঠকর্ম পরবর্তী গবেষণা: সরেজমিনে অনুসন্ধান কাজ শেষে প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তি সম্পর্কিত মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত এবং জরিপ ও অনুসন্ধানপূর্ব গবেষণাকালে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পর্যালোচনা করা হয়। এ ধাপে প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত ইট, মৃৎপাত্র ও অন্যান্য অস্থাবর সাংস্কৃতিক বস্তু সাবধানতার সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পরিমাপ করা হয় এবং আলোকচিত্র ধারণ করা হয়। সয়েল কালার চার্ট ব্যবহার করে ধ্বংসাবশেষের ঢিবি থেকে সংগৃহীত নমুনা মাটির বর্ণ এবং অনুভব পদ্ধতির সাহায্যে মাটির বুুনন নির্ণয় করা হয়। প্রাপ্ত জিপিএস ডাটা দিয়ে আর্কজিআইএস সফটওয়ার ব্যবহার করে প্রাপ্ত প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তি প্রদর্শন করে মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়। লেভেল মেশিন ব্যবহার করে নির্ণিত উচ্চতা পরিমাপের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সম্মোন্নতি রেখা ও ক্রস সেকশন অংকনের মাধ্যমে ঢিবির উচ্চতা প্রদর্শন করা হয়। অটোক্যাড সফটওয়ার ব্যবহার করে প্রত্ননিদর্শনের গ্রাউন্ডপ্লান ও সাইটপ্লান এবং এডোবি ইলাট্রেটর সফটওয়ারের মাধ্যমে রেখাচিত্র অংকন করা হয়। প্রাপ্ত প্রতিটি প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তির জন্য আলাদা আলাদা সাইট কোড প্রদান করা হয়।
ঘ) প্রতিবেদন উপস্থাপন: সরেজমিনে জরিপ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্নস্থল ও পুরাকীর্তি, এদের সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত এবং প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থসমূহের বর্ণনা পর্যালোচনা শেষে লিপিবদ্ধাকারে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
সহায়িকা: Knudson, S.L., Culture in Retrospect, WAVEland Press, INC, Prospect Heights, Illinois 60070.
লেখক: মো. শাহীন আলম।
আলোকচিত্র: সংগৃহীত।
▶ প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পদ্ধতি ও কৌশল