পুরাতন কালেক্টরেট ভবন: বর্তমান বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর
অবস্থান: ঐতিহাসিক পুরাতন কালেক্টরেট ভবন বা বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর (museum) বরিশাল জেলা শহরে অবস্থিত। শহরের সদর রোডস্থ কাকলী মোড় থেকে লঞ্চঘাটগামী সড়কের নগর ভবন (বরিশাল সিটি কর্পোরেশন) সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে কালেক্টরেট ভবনটি দেখা যায়। এ ভবনটির পূর্ব পাশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়গামী সড়ক ও জেলা সদর পোস্ট অফিস, পশ্চিম পাশে লাগোয়া বিভাগীয় হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, দক্ষিণ পাশে ১টি পুকুর ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উত্তর পাশে ফজলুল হক এভিনিউ ও জেলা পরিষদ অবস্থিত।
মানচিত্র: বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরের অবস্থান।
পটভূমি: রেগুলেশন-৭ অনুযায়ী ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন জমিদার আগা বাকের খানের নামানুসারে এ জেলার নামকরণ করা হয়েছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে স্যার জন শ্যোর এ জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বর্তমানের বরিশাল শহরে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীতে এ জেলাটি বরিশাল নামে পরিচিতি পায়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে এ জেলাটিকে কালেক্টরেটে পরিণত করা হয়। দাপ্তরিক প্রয়োজনে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে বরিশালে কালেক্টরেট ভবন (পুরাতন কালেক্টরেট ভবন) নির্মাণ করা হয়। এ কালেক্টরেট ভবনটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে নিম্ন-গাঙ্গেয় অববাহিকায় নির্মিত প্রথম প্রশাসনিক ভবন বলে মনে করা হয়। বহু বছর যাবৎ এ ভবনটিতে বরিশাল জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এ ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। বরিশাল জেলা প্রশাসনের পরিত্যক্ত এ ভবনটি পুরাতন কালেক্টরেট ভবন নামে পরিচিতি পায়। এরপর ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এ ভবনটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে এ ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন এ ভবনটিতে বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর চালু করা হয়।
স্থাপত্যিক বিবরণ: বরিশাল পুরাতন কালেক্টরেট ভবনটি আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত দোতলাবিশিষ্ট একটি ভবন। এ ভবনটি পাশ্চাত্য (western) ও স্থানীয় ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্য-রীতির সংমিশ্রণে নির্মাণ করা হয়। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এ ভবনটির দৈর্ঘ্য ৯৪ মিটার ও প্রস্থ ২১ মিটার। প্রায় ১.২ মিটার উঁচু খিলানবিশিষ্ট স্তম্ভের উপরে এ ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এ ভবনটির নিচতলায় ১৪টি এবং দোতলায় ১১টি কক্ষ রয়েছে। উভয় তলার দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর পাশে টানা বারান্দা রয়েছে। নিচতলার বারান্দার মেঝেতে একাধিক লোহার সিন্দুক (iron safe) দেখা যায়। সম্ভবত তৎকালে রাজস্ব আদায়ের অর্থ কিংবা প্রয়োজনীয় দলিল/জিনিসপত্র এসব সিন্দুকে রাখা হত। নিচতলার দু’টি কক্ষে লোহার তৈরি তাক (iron self) রয়েছে। সম্ভবত এ কক্ষ দু’টি রেকডরুম হিসেবে ব্যবহৃত হত। নিচতলা থেকে দোতলায় উঠার জন্য এ ভবনে দু’টি সিঁড়ি রয়েছে। দোতলার উত্তর ও দক্ষিণ পাশের বারান্দার সামনে পাশ্চাত্য তুস্কান (tuscan) স্থাপত্য রীতির একাধিক জোড়া স্তম্ভ রয়েছে। এ স্তম্ভগুলোর উপরের অংশ কাঠের খড়খড়িবিশিষ্ট প্যানেল (wooden louver panel) এবং নিচের অংশ অলংকৃত লোহার র্যালিং (iron railing) দিয়ে একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত রয়েছে। পর্যাপ্ত আলো সরবরাহের জন্য এ ভবনের ছাদে একাধিক স্কাই-লাইট (sky-light) রয়েছে। পাতলা পোড়ামাটির ইট, পোড়ামাটির টালি, লোহা ও কাঠের বর্গা এবং চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এ স্থাপনার প্রতিটি কক্ষে একাধিক দরজা ও জানালা রয়েছে। কাঠের তৈরি দরজা ও জানালাগুলোতে খড়খড়িবিশিষ্ট কপাট (louver panel) ও গ্লাসবিশিষ্ট কপাট (glass panel) ব্যবহার করা হয়েছে। ভবনটির বাহিরের দেয়ালে লাল ও অভ্যন্তরের দেয়ালে সাদা বর্ণের প্রলেপ রয়েছে। বর্তমানে এ ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিভাগীয় জাদুঘর হিসেবে বরিশাল বিভাগসহ সমগ্র বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাদুঘর পরিদর্শনের টিকিট ও সময়সূচি:
জাদুঘরের পূর্ব দিকের মূল গেটের পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য ১০/- টাকা, তবে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের জন্য টিকেট ফ্রী । মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের জন্য প্রবেশ মুল্য ৫/- টাকা। সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীর জন্য প্রবেশ মূল্য ২৫/- টাকা এবং অন্যান্য বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১০০/- টাকা করে।
গ্রীষ্মকালে (১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সকাল ১০:০০টা থেকে সন্ধ্যা ৬:০০টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। দুপুর ১:০০টা থেকে ১.৩০টা পর্যন্ত আধা ঘণ্টার জন্য বিরতি। সোমবার বেলা ২.৩০টা থেকে সন্ধ্যা ৬:০০টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। আর শীতকালে (১ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত) সকাল ৯:০০টা থেকে বিকেল ৫:০০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১:০০টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বিরতি। সোমবার বেলা ১.৩০টা থেকে থেকে বিকেল ৫:০০টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। এছাড়া প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাযের জন্য ১২:৩০টা থেকে ২:৩০টা পর্যন্ত বিরতি থাকে। প্রতি রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে নির্দেশ মোতাবেক সরকারি যেকোন বিশেষ দিবসে জাদুঘর খোলা থাকে ।
[লেখক: মো. শাহীন আলম]