প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত | Pacific Ocean Currents

প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত [Pacific Ocean Currents] বলতে মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে প্রবাহিত সমুদ্রস্রোতসমূহকে বুঝায়। প্রশান্ত মহাসাগর নামক এ বিশাল জলরাশিটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ এবং ইউরোপ (রাশিয়া), এশিয়া ও ওশেনিয়া মহাদেশের মাঝখানে অবস্থিত। নিরক্ষরেখার উত্তরাংশকে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিণাংশকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর বলা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ বর্ণনা করার সুবিধার্থে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত এবং উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত নামে দু’ভাগে বিভক্ত করে নিম্নে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল।

ক. দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত [South Pacific Ocean Currents]: নিরক্ষরেখা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ অংশে যে সব সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সে সব সমুদ্রস্রোতকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত বলা হয়। বিভিন্ন নাম ধারণ করে প্রবাহিত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হল।

ক.১. পশ্চিমা স্রোত [West Wind Current]: এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝখান দিয়ে পশ্চিমা বায়ু (প্রত্যায়ন বায়ু) পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এ পশ্চিমা বায়ু কর্তৃক পরিচালিত হয়ে একটি শীতল স্রোত ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত এ স্রোতটিই পশ্চিমা স্রোত বা পশ্চিমা বায়ু স্রোত নামে পরিচিত। স্রোতটি ক্রমেই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে গতিপথে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তের হর্ণ অন্তরীপের কাছে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর একটি শাখা উত্তর দিকে বেঁকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। পশ্চিমা স্রোতের মূল ধারাটি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করে।

ক.২. হামবােল্ডট বা পেরু স্রোত [Humboldt or Peru Current]: দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তের হর্ণ অন্তরীপের কাছে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে পশ্চিমা স্রোতের একটি ধারা বেঁকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। পশ্চিমা স্রোত থেকে উৎপন্ন এ স্রোতধারাটি দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় চিলির পাশে হামবােল্ডট স্রোত নাম ধারণ করে। এ স্রোতটি আরও অগ্রসর হয়ে পেরুর পাশে পেরু স্রোত নামে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেতে যেতে ক্রমেই উষ্ণ হতে থাকে। পরবর্তীতে এ স্রোতটি নিরক্ষীয় স্রোতধারার সাথে মিশে যায়।

ক.৩. এল নিনাে স্রোত [El Nino Current]: এল নিনো হল একটি ঋতুভিত্তিক বিপরীত উষ্ণ স্রোত প্রবাহ। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ও পেরু স্রোতের মধ্যদিয়ে ধীর গতিতে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি প্রবাহিত হয়ে কখনও কখনও আরও দক্ষিণে ক্যাসাব্লাঙ্কা পার হয়ে যায়। এ স্রোতটি ফ্রেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসে প্রবাহিত হয়।

ক.৪. দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত [South Equatorial Current]: দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলস্থ পেরু স্রোতটি উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী হয়। সেখান থেকে এ স্রোতটি দক্ষিণ-পূর্ব অয়ন বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। পরে নিরক্ষরেখার দক্ষিণ পাশ দিয়ে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত নামে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।

ক.৫. পূর্ব অস্ট্রেলীয় স্রোত [East Australian Current]: প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যভাগ দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় ১২,৮০০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে পাপুয়া নিউগিনির কাছে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের একটি শাখা দক্ষিণ দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতধারাটি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় পূর্ব অস্ট্রেলীয় স্রোত নাম ধারণ করে।

ক.৬. নিউ সাউথ ওয়েলস স্রোত [New South Wales Current]: পূর্ব অস্ট্রেলীয় স্রোতটি দক্ষিণে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পাশে নিউ সাউথ ওয়েলস স্রোত নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত

খ. উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত [North Pacific Ocean Currents]: নিরক্ষরেখা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর অংশে যে সব সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সে সব সমুদ্রস্রোতকে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত বলা হয়। বিভিন্ন নাম ধারণ করে প্রবাহিত উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হল।

খ.১. উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত [North Equatorial Current]: উত্তর-পূর্ব অয়ন বায়ু কর্তৃক পরিচালিত হয়ে একটি স্রোতধারা প্রথমে উত্তর আমেরিকার মেক্সিকোর পশ্চিম উপকূল থেকে উত্তর-পশ্চিমে এবং পরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নিরক্ষরেখার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নিরক্ষরেখার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ স্রোতটি উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত নামে পরিচিতি পায়। মূলত এটি একটি উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এ স্রোতটি ক্রমেই পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে এশিয়ার ফিলিপাইনের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়।

খ.২. কুরোশিও বা জাপান স্রোত [Kuroshio or Japan Current]: দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের একটি শাখা নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিমাভিমুখী প্রবাহিত হয়ে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব উপকূলে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। সেখান থেকে তাইওয়ান (ফরমােজা) ও চীনের উপকূলের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। তাইওয়ানের কাছে এ স্রোতটির সাথে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত মিলিত হয়। এ স্রোতটি জাপানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুরোশিও বা জাপান স্রোত নাম ধারণ করে। এরপর স্রোতটি কুরোশিও বা জাপান স্রোত নামে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়।

খ.৩. সুশিমা স্রোত [Tsushima Current]: কুরোশিও বা জাপান স্রোতের প্রবাহিত একটি শাখা জাপানের দক্ষিণ দ্বীপ শিকোকুর পশ্চিম পাশ দিয়ে জাপান সাগরে প্রবেশ করে। এ স্রোতটি জাপানের পশ্চিম উপকূল বরাবর পশ্চিমা স্রোত বা সুশিমা স্রোত নাম ধারণ করে। উষ্ণ সুশিমা স্রোতটি উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়।

খ.৪. উত্তর প্রশান্ত প্রবাহ [North Pacific Drift]: উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যভাগ অতিক্রম করার পর কুরোশিও বা জাপান স্রোতটি উত্তর প্রশান্ত প্রবাহ নামে উত্তর-পূর্ব ও উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি প্রবাহিত হয়ে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের কাছে দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়।

খ.৫. ক্যালিফোর্নিয়া স্রোত [California Current]: উত্তর প্রশান্ত প্রবাহের প্রথম শাখা উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে দক্ষিণ দিকে বেঁকে ক্যালিফোর্নিয়া উপদ্বীপের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়। প্রবাহিত এ স্রোতটি ক্যালিফোর্নিয়া স্রোত নামে আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের সাথে মিলিত হয়।

খ.৬. আলাস্কা স্রোত (Alaskan Current): উত্তর প্রশান্ত প্রবাহের দ্বিতীয় শাখাটি আলাস্কা স্রোত নামে আলাস্কা সাগরে প্রবেশ করে। এ স্রোতধারাটি দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে প্রথমে উত্তর-পূর্ব এবং পরে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। উপকূলে বাঁধা পেয়ে এ স্রোতধারাটি আবার উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ও পরে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ প্রবাহধারা আলাস্কা সাগরে ঘূর্ণয়মান স্রোত প্রবাহের সৃষ্টি করে। 

খ.৭. বেরিং স্রোত [Bering Current]: এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মাঝে অবস্থিত সংকীর্ণ বেরিং প্রণালী মধ্য দিয়ে একটি শীতল স্রোতধারা উত্তর মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়।

খ.৮. কামচাটকা স্রোত [Kamchatka Current]: বেরিং প্রণালীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত শীতল বেরিং স্রোতটি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে কামচাটকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি কামচাটকা স্রোত নাম ধারণ করে ওখটস্ক সাগরে প্রবেশ করে। ওখটস্ক সাগর থেকে বের হয়ে স্রোতটি হোক্কাইডোর পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ওয়াশিও স্রোত নামে আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়।  এ স্রোতটি উষ্ণ কুরোশিও স্রোতের পাশ দিয়ে বিপরীত দিকে প্রবাহিত হলে শীতল ও উষ্ণ স্রোতের সংমিশ্রণে কুয়াশা ও ঝড়ের সৃষ্টি করে। এছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরে নিম্নে উল্লেখিত স্রোত প্রবাহিত হতে দেখা যায়।

গ. নিরক্ষীয় বিপরীত স্রোত [Counter Equatorial Current]: উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত ও দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের মধ্য দিয়ে একটি উষ্ণ স্রোত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি প্রায় ৫° উত্তর অক্ষাংশ মধ্যে অবস্থান করে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের চেয়ে প্রশান্ত মহাসাগর বেশি বিস্তৃত। আর এ কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের এ প্রতিস্রোতটি আটলান্টিক মহাসাগরে প্রতিস্রোতের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা:
১. রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, প্রাকৃতিক ভূগোল, ২০১৭-২০১৮, কবির পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
২. Singh, Savindra, Physical Geography, 2009, Prayag Pustak Bhawan, Allahabad.


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *