প্রাচীন প্রস্তর যুগ | The Palaeolithic Age
সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে প্রাচীন প্রস্তর যুগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রাচীন প্রস্তর যুগের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Palaeolithic Age। Palaeo শব্দের অর্থ হল পুরাতন এবং Lithos শব্দের অর্থ হল পাথর। প্রস্তর যুগের প্রথম পর্যায় হল প্রাচীন প্রস্তর যুগ। প্রস্তর যুগের মধ্যে এটি সবচেয়ে দীর্ঘ। প্রাথমিকভাবে প্রাচীন প্রস্তর যুগের সময় ধরা হয়েছিল খ্রীস্টপূর্ব পনের লক্ষ থেকে দশ অব্দ পর্যন্ত। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণাদির অভাবে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এ যুগের সময়কে সংক্ষিপ্ত করে এক লক্ষ থেকে দশ হাজার অব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। প্রাচীন প্রস্তর যুগেই মানবসভ্যতার বিকাশের প্রথম ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। প্রাপ্ত তথ্য-উপাওের ভিত্তিতে প্রাচীন প্রস্তর যুগকে তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন-
১. প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রাথমিক পর্যায়
২. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মাধ্যমিক পর্যায়
৩. প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়।
১. প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রাথমিক পর্যায়: খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ছয় লক্ষ অব্দ পর্যন্ত সময়কে প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রাথমিক পর্যায় অভিহিত করা হয়েছে। হাইডেলবার্গ মানব হল এ যুগের অন্যতম জীবাশ্ম। প্রাচীন প্রস্তর যুগের এ পর্যায়ের মানুষদের ‘প্রায় মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরা বুদ্ধি, মেধায় ও দক্ষতায় নিম্নমানের ছিল। এ যুগের মানুষেরা অরণ্য আর গুহায় বাস করত। বন-বনান্তরে ঘুরে বেড়াত খাদ্য অন্বষণের জন্য। ধীরে ধীরে তারা মেধা, অভিজ্ঞাতা আর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পাথর ঘষে সূচালো আর তীক্ষ্ণ করে পশু শিকারের কৌশল আয়ত্ত্ব করতে সক্ষম হয়। এ যুগের মানুষ ছিল প্রধানত শিকারি ও খাদ্য সংগ্রহকারী। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ আগুনের ব্যবহার জানত বলে অনেকে ধারনা করেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শীতল যুগে এদের অস্তিত্ব ছিল। জাভার পিথেক্যান্থপাস, চীনের সিনান্থ্রপাস, আলজেরিয়ার আটলান্থ্রপাস নরগোষ্ঠী এ যুগে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত।
২. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মাধ্যমিক পর্যায়: খ্রিষ্টপূর্ব এক লক্ষ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ত্রিশ হাজার অব্দ পর্যন্ত সময়কে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মাধ্যমিক পর্যায় বলে অভিহিত করা হয়। এ যুগের মানুষেরা লজ্জা ঢাকার জন্য মৃগচর্ম পরিধান করতে শেখে। তারা শিকারের উপযোগী পাথরের ধারালো সূক্ষ্ম ও মসৃণ অস্ত্র যেমন – দু’প্রান্ত তীক্ষ্ণ বর্শা, ছুরি, চাঁছাড়, তিন কোনো, চার কোনো আকৃতির অস্ত্র ইত্যাদি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এরা শীতের তীব্রতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য পশুর চামড়া পরিধান এবং গুহায় বসবাস করত। এ যুগের মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত। এ যুগের উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী নিয়ান্ডারথাল বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে বসবাস করত। এ যুগের গুহাচিত্র তখনকার ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিল্পবোধের পরিচয় বহন করে।
৩. প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়: খ্রিষ্টপূর্ব ত্রিশ হাজার অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব দশ হাজার অব্দ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়। এ পর্যায়ে এসে মানুষেরা শেষ হিমশীতল যুগের কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে শেখে। এ যুগে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল বর্শা নিক্ষেপ যন্ত্র, হারপুন, তীর-ধনুক ও হাড়ের তৈরি সুচ, চাকু, করাত, আল, বড়শি, বাটালি, কাঠ খোদাই ও অন্যান্য হস্তশিল্প ইত্যাদি। তীর-ধনুক ও হাড়ের তৈরি হারপুন দ্বারা পশু শিকার অনেকটা সহজ হয়েছিল। ক্রোম্যাগনন নরগোষ্ঠী হল এ যুগের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা। স্পেন ও দক্ষিণ ফ্রান্সের গুহায় এ যুগের নিপুণ শিল্পকর্মের নিদর্শন পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন, এ যুগের মানুষ গুহাচিত্রে রঙের ব্যবহারও করত। [ইশরাত জাহান মিম]
সহায়িকা: সরকার, ড. মোহাম্মদ আব্দুল মালেক, (২০২২), সমাজ বিজ্ঞান, লেকচার পাবলিকেশন্স লি. ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯।