ফসফরাস চক্র: ফসফরাস চক্রে মানুষের প্রভাব এবং পরিবেশ দূষণ
ফসফরাস (phosphorus) প্রাকৃতিক পরিবেশে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না। ফসফরাস ভৌত পরিবেশে ও জীব পরিবেশে বিভিন্ন যৌগ রূপে বিরাজ করে। ভৌত পরিবেশের অশ্মমণ্ডলের মাটিতে ও বারিমণ্ডলের পানিতে ফসফেট (PO43-) রূপে এবং জীব পরিবেশে জীবের দেহ গঠনকারী বৃহৎ জৈব অণু রূপে ফসফরাস পাওয়া যায়। বংশগতি বহনকারী বস্তু রাইবোনিউক্লিক এসিড (RNA) এবং ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (DNA), অস্থি (bone) এবং কোষ ঝিল্লি (cell membrane) গঠনকারী উপাদান হল ফসফোলিপিড (phospholipid)। এ ফসফোলিপিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ফসফরাস।
ফসফরাস চক্র (phosphorus cycle): সাধারণত ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে ফসফরাসের চক্রাকার প্রবাহকে ফসফরাস চক্র বলা হয়। ফসফরাস একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফসফেটে (PO43-) রূপান্তরিত হয়। উদ্ভিদ ফসফরাসকে দ্রবীভূত ফসফেট আকারে গ্রহণ করে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রাণী খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে ফসফরাস গ্রহণ করে। আবার, বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ থেকে ফসফরাস ভৌত পরিবেশের অশ্মমণ্ডলে ও বারিমণ্ডলে ফিরে যায়। উদ্ভিদ পুনরায় একই প্রক্রিয়ায় ফসফেট গ্রহণ করে। এরূপে ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে ফসফরাসের চক্রাকারের প্রবাহ চলতে থাকে।
ফসফরাস চক্রের পদ্ধতি (the mechanism of phosphorus cycle): দুটি আন্ত:সংযোগী পরিবেশগত পর্যায়ের মধ্যে ফসফরাস চক্র সম্পন্ন হয়। একটি স্থলভাগে সম্পন্ন হয়, তাই একে স্থলজ পর্যায় বলে। অপরটি জলভাগে সম্পন্ন হয়, তাই একে জলজ পর্যায় বলে। তাই ফসফরাস চক্রের পদ্ধতিকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করে নিন্মে আলোচনা করা হল।
১. ফসফরাস চক্রের স্থলজ পর্যায় (terrestrial phase of phosphorus cycle): ভৌত পরিবেশের পাহাড় ও সমতল জমি থেকে উদ্ভিদ (উৎপাদক) ফসফেট রূপে প্রচুর ফসফরাস গ্রহণ করে। জীব পরিবেশের প্রাণী খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে ফসফেট রূপে ফসফরাস গ্রহণ করে। এবার প্রাণীর রেচন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ফসফেট রূপে ফসফরাস ভৌত পরিবেশে ত্যাগ করে। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত দেহাবশেষে পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে ফসফেট রূপে ফসফরাস ভৌত পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। এছাড়া কৃষি কাজে প্রচুর ফসফেট সার প্রয়োগের কারণে জীব পরিবেশে প্রচুর ফসফরাস প্রবাহিত হয়।
২. ফসফরাস চক্রের জলজ পর্যায় (aquatic phase of phosphorus cycle): ভৌত পরিবেশের পাহাড়ে ও সমতল জমিতে ফসফেট রূপে প্রচুর ফসফরাস থাকে। বরফ গলা পানি ও বৃষ্টির পানি পাহাড় ও জমি ক্ষয় করে পানির সাথে দ্রবীভূত ফসফেট রূপে ফসফরাস স্থানান্তরিত করে থাকে। দ্রবীভূত এ ফসফেট নদীর পানির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়। জীব পরিবেশের জলজ উদ্ভিদ (উৎপাদক) নদী এবং সমুদ্রের পানি থেকে দ্রবীভূত ফসফেট রূপে ফসফরাস গ্রহণ করে। পরে খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে জলজ প্রাণী ফসফেট রূপে ফসফরাস গ্রহণ করে। এবার জীব পরিবেশ থেকে প্রাণীর রেচন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ফসফেট রূপে ফসফরাস ভৌত পরিবেশে ফিরে আসে। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত দেহাবশেষে পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে ফসফেট রূপে ফসফরাস ভৌত পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়।
এছাড়া দেখা যায় যে, স্থলভাগ থেকে সমুদ্রে স্থানান্তরিত ফসফেট রূপে ফসফরাসের অধিকাংশ অধ:ক্ষিপ্ত হয়ে পানির নিচে সঞ্চিত হয়। সঞ্চিত ফসফেটের কিছু অংশ সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রয়োজনে লাগে। অবশিষ্ট অংশ সমুদ্রের তলদেশে ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়ে ফসফেটের পাহাড় সৃষ্টি হয়।
সূতরাং, ফসফরাস মৌল বিভিন্ন যৌগ রূপে ভৌত পরিবেশের মাটি ও পানি থেকে জীব পরিবেশের উদ্ভিদে এবং উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে; জীব পরিবেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে পুনরায় ভৌত পরিবেশে মাটি ও পানিতে প্রবাহের মাধ্যমে ফসফরাস চক্র চলন্ত থাকে। ফসফরাসের এ প্রাকৃতিক প্রবাহ চক্র কখনও থেমে যায় না।
ফসফরাস চক্রে মানুষের প্রভাব এবং পরিবেশ দূষণ: ফসফরাস চক্র একটি চলন্ত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। পরিবেশে ফসফরাসের ভারসাম্য নির্ভর করে ভৌত পরিবেশ থেকে জীব পরিবেশে ফসফেট রূপে ফসফরাস গ্রহণ বা ব্যবহার এবং জীব পরিবেশ থেকে ভৌত পরিবেশে ফসফেট রূপে ফসফরাস নির্গমনের সুষম আন্ত:ক্রিয়ার উপর। মানুষের অপরিকল্পিত কাজের কারণে অশ্মমণ্ডলের মাটিতে ফসফেটের নির্গমনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে অশ্মমণ্ডলে ফসফেটের পরিমাণ ক্রমাগত হারে বাড়ে। মাটি ও পানি দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হল অশ্মমণ্ডলে ফসফেটের ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। নিম্নলিখিত অপরিকল্পিত কাজের কারণে ফসফরাস চক্রে ভারসাম্যহীনতা ও পরিবেশ দূষণ হয়।
ক. ঘর্ষন দিয়াশলাই প্রস্তুতি, যুদ্ধকালে ধুম্রজাল বোমা, হাতবোমা ও আগুনে বোমা তৈরীতে ফসফরাস ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার করা। এর ফলে প্রচুর ফসফরাস অশ্মমণ্ডলে নির্গত হয়।
খ. নির্বিচারে বনভূমির উদ্ভিদ বা অরণ্য নিধন করে সবুজ আচ্ছাদনের বিলুপ্ত করা। ফলে জীব পরিবেশের উদ্ভিদ বা অরণ্য কর্তৃক ফসফেট রূপে ফসফরাস গ্রহণ বা ব্যবহার পরিমাণ হৃাস পায়। এর ফলে প্রচুর ফসফরাস অশ্মমণ্ডলেই রয়ে যায়।
গ. খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক হিসেবে ফসফেট রূপে ফসফরাস প্রয়োগ করা। ফলে ফসফেট রূপে প্রচুর ফসফরাস অশ্মমণ্ডলের মাটিতে মিশ্রিত হয়।
অশ্মমণ্ডলের মাটিতে ফসফেট রূপে মিশ্রিত প্রচুর ফসফরাস বৃষ্টির পানির সাথে বিক্রিয়া করে ফসফরিক এসিড (H3PO4) সৃষ্টি হয়। প্রচুর ফসফরিক এসিড পানি বাহিত হয়ে খাল, বিল, পুকুর, নদী প্রভৃতি জলাশয়ে পতিত হয়। ফলে পানি দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে জলজ ও স্থলজ প্রাণীর ক্ষতির কারণ হয়। ফসফরিক এসিডে দূষিত পানি পানে মানুষের কিডনি সংক্রমণ এবং হাড়ের ঘনত্ব ক্ষয় পাওয়ার মত রোগের উপদ্রব দেখা দেয়।
তথ্যসূত্র:
১. পাল, গৌতম, পরিবেশ ও দূষণ, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লি., কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৮ – ৭০।
২. Flood, W.E. and West, Michael, An Elementary Scientific and Technical Dictionary, 1962, Lowe and Brydone, London, P: 283.
লেখক: মো. শাহীন আলম।