বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ও এর সমাধান
বেকার সমস্যার অভিশাপ ছড়িয়ে পড়েছে আজ সমগ্র বাংলাদেশে। বেকার শব্দের অর্থ হলো – কর্মহীন, জীবিকাহীন, কাজের অভাব। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ না করে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় তাদেরকে বলে ভবঘুরে, অলস। যাদের কাজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এবং কাজ করার মানসিকতা থাকা সত্ত্বেও কাজ পায় না তখন তাদেরকে বলে বেকার। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার প্রতিশ্রুতিশীল যুবক পাস করে বের হয়ে বেকার সমস্যার দাবানলে পুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
এ সমস্যা সমাধানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, নতুবা জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বিলিন হতে বাধ্য। অনেকে বেকারত্বের জ্বালায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। আবার কেউ কেউ ঘৃণ্য জীবনবরণ করে এই বেকারত্বের জন্যই। তাই এ বেকারত্ব সমস্যা সম্পর্কে জানা এবং এর প্রতিকার খুঁজে বের করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বেকার সমস্যার কারণ: নানা কারণে বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক বর্তমানে বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। বেকারত্বের প্রধান প্রধান কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হল:
১. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বাংলাদেশে বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। কিন্তু সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বর্ধিত জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
২. কৃষির উপর নির্ভরশীলতা: এদেশের শতকরা প্রায় ৮৫ জন লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষি কাজও এখন সাময়িক। কেননা, কৃষকেরা ৫/৬ মাস কৃষি কাজে নিয়োজিত থাকে। বাকি সময় তাদের কোন কাজ থাকে না বলে অলস সময় অতিবাহিত করে। এ কারণে তারা মৌসুমি বেকারত্বের সম্মুখীন হয়।
৩. সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা: আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত ক্রটিপূর্ণ। শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষা পাঠ্যক্রমভূক্ত না করায় শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করতে পারে না। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষা লাভ করে বাস্তব জীবনে কেরানীগিরি এবং অন্যান্য সরকারি বেসরকারি চাকরি গ্রহণ ছাড়া তাদের আর কোন যোগ্যতা সৃষ্টি হয় না। তারা কর্মসংস্থানের উপযোগী শিক্ষা পায় না। তাই দিন দিন বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. শিল্পে অনগ্রসরতা: বাংলাদেশ শিল্পে তেমন অগ্রসর নয়। দেশে দ্রুত শিল্প কারখানা গড়ে ওঠছে না। ফলে আশানুরূপ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না এবং দিন দিন বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরন্তু অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় হাজার হাজার কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে।
৫. কারিগরি জ্ঞানের অভাব: আমাদের দেশের জনগণের কর্মসংস্থান উপযোগী কারিগরি জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে নতুন যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল প্রবর্তিত হচ্ছে। ফলে নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যারা অজ্ঞ তারা ক্রমশ বেকার হয়ে পড়ছে।
৬. সামাজিক প্রভাব: বাংলাদেশে প্রচলিত সামাজিক প্রভাব ও বেকার সমস্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী। বর্তমানে শিক্ষিত মেয়েরাও কাজ করে জাতীয় অর্থনীতিতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু সামাজিক নানা বাধার কারণে অনেক মেয়ে কাজ করতে পারে না। ফলে তারা বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে বেকারত্বের বৃদ্ধির আরো অনেক কারণ রয়েছে। যেমন: কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, শ্রমিকদের গতিশীলতার অভাব ইত্যাদি।
বেকার সমস্যা সমাধানের উপায়: নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করলে বেকার সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
১. শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
২. কৃষি ব্যবস্থার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
৩. স্কুল মেয়াদি শিক্ষার মাধ্যমে হাঁস-মুরগি চাষ, মৎস্য চাষ, মৌমাছি, গুটি পোকা, ইত্যাদি চাষাবাদ শিখিয়ে স্বল্প ঋণে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করলে বেকারত্ব কমবে।
৪. ঐতিহাসিক কুটির শিল্পগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
৫. অধিক হারে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে।
৬. বিভিন্ন সমবায় সমিতির মাধ্যমে নানা প্রকার প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
এরূপ আরও বিভিন্ন উপায় রয়েছে, যেগুলো গ্রহণের ফলে বেকারত্বের সমস্যা দূরীভূত করা সম্ভব। বেকার সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কেবল সরকারের একার নয়, এ দায়িত্ব সবার। দেশেকে উন্নতির সোপানে দাঁড় করাতে সবাই বদ্ধ পরিকর হলে এবং কাজকে শ্রদ্ধা করে সবাই সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অগ্রসর হলেই দেশ থেকে কর্মহীনতা বা বেকারত্ব অনেকটা দূর করা সম্ভব হবে। [ইশরাত জাহান মিম]