ভর বিচলনের শ্রেণীবিভাগ ও প্রক্রিয়া
পৃথিবীর ভূমিরূপ বিভিন্ন বহিঃজ শক্তির প্রভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। ভূমিরূপের এরূপ পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলো বা প্রভাবকগুলোকে বিচূর্ণীভবন (weathering), ভর বিচলন (mass wasting), ক্ষয়ীভবন (erosion), নগ্নীভবন (denudation) প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এ প্রবন্ধে ভর বিচলনের শ্রেণীবিভাগ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
ভর বিচলনের শ্রেণীবিভাগ (classification of mass movement): ভরবিচলনের সার্বিক প্রকারভেদ বা শ্রেণীবিভাগ করার জন্য ভরবিচলনের কারণ ও প্রকৃতি অনুসারে নিয়মতান্ত্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ১৯৩৮ সালে ভূবিজ্ঞানী শার্প (Sharp) – এর ভর বিচলনের বিস্তারিত ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিতভাবে ভর বিচলনের শ্রেণীবিভাগ করা হল:
ভরবিচলন – ১। প্রবাহ
২। সম্প্রপাত বা ভূপাত
১। প্রবাহ – (১.ক) ধীর গতি প্রবাহ
(১.খ) দ্রুত গতি প্রবাহ
(১.ক) ধীর গতি প্রবাহ – (i) মাটি স্খলন
(ii) টেলাস স্খলন
(ii) শিলা স্খলন
(iii) হিমবাহ স্খলন
(iv) মাটি পতন
(১.খ) দ্রুত গতি প্রবাহ – (i) মাটি প্রবাহ
(ii) টেলাস স্খলন
(iii) কর্দম প্রবাহ
(iv) হিমানী সম্প্রপাত
২। সম্প্রপাত বা ভূপাত – (২.ক) ধস
(২.খ) অধ:পতন
(২.ক) ধস – (i) হিমানী সম্প্রপাতের ধস
(ii) হিমানী সম্প্রপাতের পতন
(iii) শিলা ধস
(iv) শিলা পতন
ভর বিচলন প্রক্রিয়া (process of mass movement): উপর্যুক্ত শ্রেণীবিভাগের উপরে ভিত্তি করে ভরবিচলনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হল:
১। প্রবাহ (flow): পার্বত্য এলাকায় মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে শিথিল বা আলগা (loose) শিলাখণ্ড উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসাকে ভর বিচলনের প্রবাহ বলা হয়। সাধারণত শিলাখণ্ড উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসার সময় উপরের গতির তুলনায় নিচের দিকের গতিবেগ ক্রমশ বেশি হয়। ভর বিচলনের ক্ষেত্রে দুুই প্রকারের প্রবাহ পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
(১.ক) ধীর গতি প্রবাহ (creep)/slow movement: উচুঁ স্থান থেকে মাটি বা দানাবিশিষ্ট শিলা ধীর গতিতে নিচের দিকে নেমে আসাকে ভর বিচলনের ধীর গতি প্রবাহ বলে। ভর বিচলনের ক্ষেত্রে ধীর গতি প্রবাহ আবার ৫ প্রকারে সংঘটিত হয়। যেমন –
(i) মাটি স্খলন (soil creep): উঁচু স্থান থেকে নিচের দিকে মাটি ধীর গতিতে গড়িয়ে নেমে আসাকে ভর বিচলনে ধীর গতির মাটি স্খলন বলে। সাধারণত মধ্যাকর্ষণ শক্তি, ভূমির শুষ্কতা, গাছের শিকড়, বৃষ্টির পানি, এবং বিশেষ করে তুষার জমাটবদ্ধ হওয়া এবং গলন প্রক্রিয়ার ফলে মাটি স্খলন হয়।
(ii) টেলাস স্খলন (talus creep: পর্বতের গায়ের ক্ষুদ্র পাথরখণ্ডগুলো ঢাল বেয়ে ধীর গতিতে উঁচু থেকে নিচে নেমে আসাকে ভরবিচলনে ধীর গতির টেলাস স্খলন বলে।
(ii) শিলা স্খলন (rock creep): পর্বতের ঢাল বেয়ে শিলারাশি স্বতন্ত্রভাবে ধীর গতিতে উঁচু থেকে নিচের দিকে নেমে আসাকে ভর বিচলনে ধীর গতির শিলা স্খলন বলে।
(iii) হিমবাহ স্খলন (glacier creep): পর্বতের ঢাল বেয়ে হিমবাহ ধীর গতিতে উঁচু থেকে নিচের দিকে নেমে আসাকে ভর বিচলনের ধীর গতির হিমবাহ স্খলন বলে।
(iv) মাটি পতন (soil fall): দিনের প্রচণ্ড তাপে এবং রাতের শীতলতার কারণে উদ্ভিদহীন বা মরু এলাকায় সহজেই শিলার প্রসারণ ও সংকোচন হয়। এর ফলে কিছু মাটি মূল শিলাস্তর থেকে আলগা হয়ে যায় এবং ভূমির ঢাল বেয়ে উঁচু থেকে নিচের দিকে নেমে আসে।
(১.খ) দ্রুত গতি প্রবাহ (Rapid movement: উচুঁ স্থান থেকে মাটি বা দানাবিশিষ্ট শিলা দ্রুত গতিতে নিচের দিকে নেমে আসাকে ভর বিচলনের দ্রুত গতি প্রবাহ বলে। ভর বিচলনের ক্ষেত্রে দ্রুত গতি প্রবাহ আবার ৩ প্রকারে সংঘটিত হয়। যেমন –
(i) মাটি প্রবাহ (soil flow): পার্বত্য অঞ্চলে খরস্রোতা নদীর প্রবল স্রোতের আঘাতে ভূত্বক থেকে শিলা খণ্ড বা মাটি ভেঙ্গে এবং ক্ষয়ে দ্রুত বেগে উপর থেকে নিচের দিকে নেমে এসে পর্বতের পাদদেশে সঞ্চিত হয়। মাটির এরূপ দ্রুত গতিতে নিচের দিকে নেমে আসাকে ভর বিচলনে দ্রুতির মাটি প্রবাহ বলে। সাধারণত আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে এরূপ মাটির প্রবাহ বেশি পরিলক্ষিত হয়।
(ii) টেলাস স্খলন (talus creep): পর্বতের গায়ের ক্ষুদ্র পাথরখণ্ডগুলো ঢাল বেয়ে দ্রুত গতিতে উঁচু থেকে নিচে নেমে আসাকে ভর বিচলনে দ্রুত গতির টেলাস স্খলন বলে।
(iii) কাদা প্রবাহ (mud flow): পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতের ঢাল বেয়ে জলের প্রবল স্রোতধারা পাথরের টুকরো, বালু, মাটি প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে উপর থেকে নিচের দিকে দ্রুত গতিতে নিয়ে আসে। যা ভর বিচলনে দ্রুত গতির কর্দম বা কাদা প্রবাহ নামে পরিচিত। পাথরের টুকরো, বালু, মাটি প্রভৃতি পদার্থ স্রোতধারার জলের পরিমাণের তুলনায় এত বেশি পরিমাণে থাকে যে, তা অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে কাদা প্রবাহে রূপ নেয়। উদাহরণ স্বরূপ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের সানক্রায়েন্স পর্বতের কাদা প্রবাহের কথা উল্লেখ করা যায়।
(iv) হিমানী সম্প্রপাত (avalanche): পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতের ঢাল বেয়ে অগ্রসরমান ধীর গতি সম্পন্ন হিমবাহের কোন অংশ বিচ্ছিন্ন বা বিচ্যুত হয়ে পড়লে মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে তা দ্রুত গতিতে নিচের দিকে ছুটে চলতে থাকাকে হিমানী সম্প্রপাত বলে। এরূপ বিচ্যুত বরফ স্তূপের আঘাতে পর্বত ঢালের গাছপালা এবং ঘর বাড়ি নিমিষে উৎপাদিত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়।
২। সম্প্রপাত বা ভূপাত (landslide): পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে আসার সময় যদি প্রস্তরখণ্ডের উপরের গতি নিচের গতির সমান হয় তবে তাকে সম্প্রপাত বা ভূপাত বলে। ভর বিচলনের ক্ষেত্রে দুুই প্রকারের সম্প্রপাত বা ভূপাত পরিলক্ষিত হয়। যেমন – (২.ক) ধস এবং (২.খ) অধঃপতন।
(২.ক) ধস (slide): পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শ কোমল শিলা স্তরের উপরে কঠিন শিলা স্তর থাকে। শিলার ফাটলের মধ্য দিয়ে পানি অনুপ্রবেশের করলে কোমল শিলা স্তর দ্রবীভূত হয়। ফলে দ্রবীভূত পিচ্ছিল কোমল শিলা স্তরের উপর দিয়ে কঠিন শিলা স্তর ধসে পড়ে। ভর বিচলনের ক্ষেত্রে ধস আবার ৪ প্রকারে সংঘটিত হয়। যেমন –
(i) হিমানী সম্প্রপাতের ধস (avalanche slide): পার্বত্য অঞ্চলে হিমানী সম্প্রপাতের সময় এর কোন অংশ ধস আকারে ঢাল বেয়ে উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসতে পারে। এ ধরনের ধসের ফলে ভূ-ভাগে ফাটল, পর্যায়ক্রমিক টিবি এবং নিম্ন ভূমির সৃষ্টি হতে পারে।
(ii) হিমানী সম্প্রপাতের পতন (avalanche fall): পার্বত্য অঞ্চলে হিমানী সম্প্রপাতের সময় এর কোন অংশ অনেক সময় খাড়া পাহাড় বা পর্বত থেকে মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে সরাসরি নিচে এসে পতিত হয়। হিমবাহের এরূপ পতনকে ভর বিচলনে হিমানী সম্প্রপাতের পতন বলা হয়।
(iii) শিলা ধস (rock slide): পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতের শিলায় চ্যুতি সৃষ্টির ফলে প্রায়শ শিলার একক স্তূপ ধস আকারে ঢাল বেয়ে উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসতে পারে। শিলার এরূপ পতনকে ভর বিচলনে শিলা ধস বলা হয়।
(iv) শিলা পতন (rock fall): পার্বত্য অঞ্চলে শিলাস্তূপ খাড়া পাহাড় বা পর্বত থেকে মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে হঠাৎ সরাসরি নিচে এসে পতিত হয়। শিলাস্তূপের এরূপ পতনকে ভর বিচলনে শিলা পতন বলা হয়।
(২.খ) অধ:পতন (downfall): কোন প্রাকৃতিক কিংবা যান্ত্রিক কারণে ভূত্বকের কঠিন শিলাস্তরের নিচ থেকে শিলা অপসারিত হলে অনেক সময় ভূত্বক লম্বালম্বিভাবে ফেটে নিচের দিকে অবনতি (downfall) ঘটে। ভূ-ত্বকের এরূপ অবনতিকে ভর বিচলনে অধ:পতন বলা হয়। [মো: শাহীন আলম]
সহায়িকা:
১. মাহমুদ. কাজী আবুল, ভূগোল কম্প্রিহেনসিভ, ২০০৩, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৬২ – ৬৫।
২. Singh, Savindra, Physical Geography, 2009, Prayag Pustak Bhawan, Allahabad, page 203-212.