ভারত মহাসাগরীয় স্রোত | Indian Ocean Currents

ভারত মহাসাগরীয় স্রোত [Indian Ocean Currents] বলতে মূলত ভারত মহাসাগরের মধ্যে প্রবাহিত সমুদ্রস্রোতসমূহকে বুঝায়। ভারত মহাসাগর নামক এ বিশাল জলরাশিটি আফ্রিকা মহাদেশ এবং এশিয়া ও ওশেনিয়া মহাদেশের মাঝখানে অবস্থিত। নিরক্ষরেখার উত্তরাংশকে উত্তর ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণাংশকে দক্ষিণ ভারত মহাসাগর বলা হয়। ভারত মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ বর্ণনা করার সুবিধার্থে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় স্রোত এবং উত্তর ভারত মহাসাগরীয় স্রোত নামে দু’ভাগে বিভক্ত করে নিম্নে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল।

ক. দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় স্রোত [South Indian Ocean Currents]: নিরক্ষরেখা থেকে ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ অংশে যে সব সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সে সব সমুদ্রস্রোতকে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় স্রোত বলা হয়। বিভিন্ন নাম ধারণ করে প্রবাহিত দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হল।

ক.১. পশ্চিমা স্রোত [West Wind Current]: এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ও আফ্রিকা মাঝখান দিয়ে পশ্চিমা বায়ু (প্রত্যায়ন বায়ু) পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এ পশ্চিমা বায়ু কর্তৃক পরিচালিত হয়ে একটি শীতল স্রোত আটলান্টিক মহাসাগর থেকে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত এ স্রোতটিই পশ্চিমা স্রোত বা পশ্চিমা বায়ু স্রোত নামে পরিচিত। স্রোতটি ক্রমেই দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে গতিপথে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলে লিউ-উইন অন্তরীপে বাঁধাপ্রাপ্ত এবং এর একটি শাখা উত্তর দিকে বেঁকে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। পশ্চিমা স্রোতের মূল ধারাটি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করে।

ক.২. অস্ট্রেলীয় স্রোত [Australia Current]: অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলে লিউ-উইন অন্তরীপের কাছে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে পশ্চিমা স্রোতের একটি ধারা বেঁকে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি অস্ট্রেলিয়া স্রোত নামে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেতে যেতে ক্রমেই উষ্ণ হতে থাকে। পরবর্তীতে এ স্রোতটি ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম উপকূলের কাছে নিরক্ষীয় স্রোতধারার সাথে মিশে যায়।

ক.৩. দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত [South Equatorial Current]: অস্ট্রেলিয়া স্রোতটি উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম উপকূলের কাছে নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী হয়। সেখান থেকে এ স্রোতটি দক্ষিণ-পূর্ব অয়ন বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। পরে নিরক্ষরেখার দক্ষিণ পাশ দিয়ে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত নামে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। আফ্রিকার তানজানিয়ার কাছে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতটি দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়।

ক.৪. মােজাম্বিক ও মাদাগাস্কার স্রোত [Mozambique and Madagascar Current]: দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের বিভক্ত দুইটি শাখার মধ্য থেকে একটি শাখা আফ্রিকার তানজানিয়ার কাছে বেঁকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে মাদাগাস্কার দ্বীপের পূর্ব পাশ দিয়ে মাদাগাস্কার স্রোত নামে এবং মাদাগাস্কার ও আফ্রিকার মূল ভূ-ভাগের মধ্যবর্তী মােজাম্বিক প্রণালীর মধ্য দিয়ে মােজাম্বিক স্রোত নামে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। এ স্রোতদ্বয় মাদাগাস্কার দ্বীপের দক্ষিণ দিকে এসে পুনরায় পরস্পর মিলিত হয়।

ক.৫. আগুলহাস স্রোত [Agulhas Current]: মােজাম্বিক স্রোত ও মাদাগাস্কার স্রোতের মিলিত ধারা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের আগুলহাস অন্তরীপের পাশ দিয়ে আগুলহাস স্রোত নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমা স্রোতের সাথে মিলিত হয়।

ভারত মহাসাগরের স্রোতসমূহ

খ. উত্তর ভারত মহাসাগরীয় স্রোত [North Indian Ocean Currents]: নিরক্ষরেখা থেকে ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশে যে সব সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সে সব সমুদ্রস্রোতকে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় স্রোত বলা হয়। বিভিন্ন নাম ধারণ করে প্রবাহিত উত্তর ভারত মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হল।

খ.১. সােমালী স্রোত [Somali Current]: দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের অপর একটি শাখা উত্তর-পশ্চিমাভিমুখী প্রবাহিত হয়ে আফ্রিকার তানজানিয়ার কাছে পূর্ব উপকূলে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। তানজানিয়ার কাছ থেকে উত্তর দিকে বেঁকে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে সোমালিয়ার পাশ দিয়ে সােমালী স্রোত নামে উত্তর -পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়।

খ.২. গ্রীষ্মের মৌসুমী স্রোত [Summer Monsoon Current]: গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সােমালী স্রোত উত্তর -পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল দিয়ে প্রবাহিত হয়। স্রোতটি এশিয়ার দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ ও ভারতের দাক্ষিণাত্য উপদ্বীপের উপকূলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ স্রোতটি আরব সাগর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একটু বেঁকে শ্রীলংকার দক্ষিণ দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। স্রোতটি বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করার পরে মালাক্কা প্রণালীর মধ্যে প্রবেশ না করে সুমাত্রার সাথে মিলিত হয়।

খ.৩. শীতের মৌসুমী স্রোত [Winter Monsoon Current]: শীতকালে মালয় উপদ্বীপ ও সুমাত্রার মধ্যবর্তী মালাক্কা প্রণালী মধ্যদিয়ে আগত স্রোত উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে পড়ে। তখন উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু দাক্ষিণাত্যের পূর্ব উপকূল এবং আরব উপকূল বরাবর উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমামুখী স্রোত সৃষ্টি করে। শীতের মৌসুমী স্রোত আফ্রিকার পূর্ব উপকূল বরাবর দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে এবং নিরক্ষীয় বিপরীত স্রোতের সাথে মিলিত হয়। অর্থাৎ শীতের মৌসুমী স্রোতটি গ্রীষ্মের মৌসুমী স্রোতের বিপরীতে প্রবাহিত হয়।

গ. নিরক্ষীয় বিপরীত স্রোত [Counter Equatorial Current]: নিরক্ষীয় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে একটি উষ্ণ স্রোত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। নিরক্ষীয় বিপরীত স্রোত নামের এ স্রোতটি প্রায় ৫° দক্ষিণ অক্ষাংশ মধ্যে অবস্থান করে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা:
১. রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, প্রাকৃতিক ভূগোল, ২০১৭-২০১৮, কবির পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
২. Singh, Savindra, Physical Geography, 2009, Prayag Pustak Bhawan, Allahabad.


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *