মানব জীবনের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব
পৃথিবীর এক গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ অংশ হলো সমুদ্র। আর আমরা জানি যে, সমুদ্রের পানি কখনো একস্থানে স্থির থাকে না। বায়ুর মতো সমুদ্রের পানিও সবসময় চলাচল করে। একস্থান থেকে অন্যস্থানে সমুদ্রের পানির নির্দিষ্ট ও নিয়মিত গতিকে সমুদ্রস্রোত (ocean current) বলে। আর মানব জীবনের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব নানাভাবে পরিলক্ষিত হয়। সমুদ্রে প্রবাহিত উষ্ণ ও শীতল স্রোত একটি দেশের জলবায়ু ও বাণিজ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
ক. বাণিজ্যের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব:
১. উষ্ণ আটলান্টিক স্রোতের প্রভাবে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমাংশে এবং নরওয়ের উত্তরে সারা বছর ধরে জাহাজ চলাচল করতে পারে। আবার বাল্টিক সাগরে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হতে পারে না বিধায় শীতকালে বাল্টিক সাগরে পানি জমে যায়। উষ্ণ জাপান স্রোতের প্রভাবে কানাডার পশ্চিম উপকূল ও ভ্যাংকুভার দ্বীপ বরফমুক্ত থাকে। তবে শীতল ল্যাব্রাতর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূল এবং শীতল বেরিং স্রোতের প্রভাবে কোরিয়ার উত্তরের এশিয়ার পূর্ব উপকূল বরফাচ্ছন্ন হয়ে যায়। শীতকালে সমুদ্রের পানি জমে যাওয়ায় নিউইয়র্ক বন্দরে জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না।
২. সামুদ্রিক জাহাজ চলাচলের উপর সমুদ্রস্রোত যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। স্রোতের অনুকূলে জাহাজ চালিয়ে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয়। কিন্তু স্রোতের প্রতিকূলে জাহাজ চালাতে ভীষণ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপগামী জাহাজ উপসাগরীয় স্রোতের গতিপথে অগ্রসর হয়ে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে। তবে ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকাগামী জাহাজ পূর্বোক্ত পথে অগ্রসর হয়ে বিলম্বে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে।
৩. উষ্ণ স্রোতের গতিপথে জাহাজ চালানো নিরাপদ। তবে শীতল স্রোত উচ্চ অক্ষাংশ থেকে আসার সময় হিমশৈল ভাসিয়ে আনে। ঐসব হিমশৈলের সংঘাতে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি নিমজ্জিত হতে পারে। বিশ্ববিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ হিমশৈলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিমজ্জিত হয়েছিল। তবে বর্তমান রাডারের সাহায্য হিমশৈল দেখে আগে থেকে সাবধান হওয়া যায়।
৪. শীতল স্রোতের সাথে ভাসমান হিমশৈল উষ্ণ স্রোতের সংস্পর্শে এসে গলে যায় এবং এর সাথে আনীত কাদা, বালু, পাথর, কাঁকর, নুড়ি প্রভৃতি উভয় মিলনস্থলে সমুদ্রের তলদেশে সঞ্চিত হয়ে মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। উত্তর আমেরিকার নিউফাউন্ডল্যান্ডের নিকট বিখ্যাত গ্র্যান্ড ব্যাংকস এবং ইউরোপের কাছে উত্তর সাগরের ডগার ব্যাংকস এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।
৫. বিভিন্ন উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে মগ্নচড়ার নিকটে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন ও প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় মাছের বিভিন্ন খাদ্য প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। শীতল স্রোতের সাথে প্রচুর মাছ ভেসে আসে। এরা শীতল ও উষ্ণ স্রোতের সন্ধিস্থলে মগ্নচড়ার নিকটে থেকে যায়। এসব কারণে নিউফাউন্ডল্যান্ড, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, নরওয়ে ও জাপানের উপকূলে শ্রেষ্ঠ মৎস্য চারণক্ষেত্রগুলো রয়েছে। এসব স্থানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় বিধায় পার্শ্ববর্তী ভূভাগে অনেক মৎস্য ব্যবসায় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
খ. জলবায়ুর উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব:
১. প্রতিটি উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলের জলবায়ুর উপর সমুদ্রস্রোতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যেমন – উষ্ণ স্রোতের উপর দিয়ে আগত বায়ু উপকূলীয় দেশগুলোর উত্তাপ বাড়ায়। পক্ষান্তরে, শীতল স্রোত উপকূলীয় দেশগুলোর জলবায়ুকে তুলনামূলক শীতল করে। উষ্ণ উত্তর আটলান্টিক স্রোতের প্রভাবে শীতকালে ইংল্যান্ড ও নরওয়ে এবং উষ্ণ কুরোশিও স্রোতের প্রভাবে জাপানের ঠান্ডা হ্রাস পায়। লন্ডন অপেক্ষা নিউইয়র্ক দক্ষিণে অবস্থিত হলেও নিউইয়র্কের কাছ দিয়ে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত প্রবাহিত হয়। বিধায় সেখানে শীতকালে লন্ডন অপেক্ষা তীব্র শীত অনুভূত হয় এবং সেন্ট লরেন্স নদীর মোহনা ও নিউফাউন্ডল্যান্ডের নিকটস্থ সমুদ্রের পানি জমে যায়।
২. উষ্ণ স্রোতের উপর দিয়ে সমুদ্র বায়ু প্রবাহিত হয়ে স্থল ভাগের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প ধারণ করে। এ বায়ু শীতল অঞ্চলে প্রবাহিত হলে উপকূলের নিকট বেশি বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি করে। আবার শীতল স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় দেশের বায়ু অধিক শীতল হয়। ঐ বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি না হয়ে তুষারপাত হয়৷ তাই ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার ল্যাব্রাডর উপদ্বীপে প্রচুর তুষারপাত হয়।
৩. উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে এদের পরস্পরের তাপের অধিক তারতম্যের কারণে এবং অতি অল্প স্থানে বেশি তাপের পরিবর্তনের ফলে কুয়াশা ও ঝড়বৃষ্টি হয়। তাই নিউফাউন্ডল্যান্ড ও জাপানের পূর্ব উপকূল কুয়াশা ও ঝড় সংঘটিত হতে দেখা যায়। তবে এ ধরনের আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে নৌচলাচল বিপদের সম্ভবনা থাকে।
সুতরাং দেখা যায় মানবজীবনের উপর সমুদ্রস্রোত নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। [ইশরাত জাহান মিম]
সহায়িকা: মজুমদার, তাপস কুমার, (২০২৩), ভূগোল, লেকচার পাবলিকেশন্স লি., ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩২১-৩২২।