শশী লজ: ময়মনসিংহ জাদুঘর | Museum

অবস্থান: শশী লজ ময়মনসিংহ জেলাধীন সদর উপজেলার টাউন মৌজায় অবস্থিত। এটি ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এবং ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে ৩০০মিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এটি ময়মনসিংহ সরকারি মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের সংলগ্নে অবস্থিত ৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি জমিদার বাড়ি। এটি স্থানীয়ভাবে ময়মনসিংহ রাজবাড়ি হিসেবেও পরিচিত।
মানচিত্র: শশী লজ-এর অবস্থান।
স্থাপত্যিক বিবরণ: উত্তরমুখী করে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে শশী লজ নামক ১টি দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। মূল এ প্রাসাদের সামনে রয়েছে ১টি ফুলের বাগান এবং ফোয়ারাযুক্ত মার্বেল পাথরের ১টি অর্ধনগ্ন নারী মূর্তি। জানা যায় যে, এ মূর্তিটি হল গ্রিক দেবী ভেনাসের।
উত্তরমূখী করে নির্মিত শশী লজটির প্রধান প্রবেশপথ বরাবর ১টি প্রলম্বিত বারান্দা রয়েছে। বারান্দাটি একান্থাস (acanthus) পত্রে সজ্জিত করিন্থিয়ান স্তম্ভের (corinthian column) উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বারান্দার অলংকৃত কার্ণিস বরাবর জন্তুর প্রতিমূর্তিযুক্ত ছাদের পানি নিষ্কাশনের নহর (gurgle) দেখা যায়। এ বারান্দা হয়ে সামনে এগিয়ে গেলে এ প্রাসাদের প্রধান প্রবেশপথটি অবস্থিত। অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত (semi-circular arched) এবং আকারে বড় এ প্রবেশপথ বরারব ছাদের উপরে ত্রিকোণাকার পেডিমেন্ট (pediment) রয়েছে। পেডিমেন্টটি ফুলের নকশা দিয়ে সজ্জিত। প্রধান প্রবেশপথের উভয় দিকে অলংকৃত দেয়ালসহ একক অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের উভয় দিকে রয়েছে করিন্থিয়ান স্তম্ভ (corinthian column)। প্রাসাদটির উভয় দিকে ২টি এবং কেন্দ্রে ১টিসহ মোট ৩টি উদগত বারান্দাসহ মূল প্রাসাদটি প্রতিসম। কেন্দ্রীয় অংশে সমান সমান ব্যবধানে ১২টি করিন্থিয়ান স্তম্ভ (corinthian column) রয়েছে। প্রাসাদের প্রধান প্রবেশপথে বারান্দার পরে ১টি হলঘর রয়েছে। হলঘরের মেঝেটি (floor) কাঠের তৈরী। এটি মূলত নাচঘর (ballroom) হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর পেছনে দক্ষিণাংশে ১টি প্রশস্থ টানা বারান্দা রয়েছে। নাচঘর (ballroom) এর পশ্চিমের কক্ষটিতে মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কক্ষসমূহের প্রবেশপথগুলোর সাথে সংযুক্ত কাঁচের ফলক রয়েছে। এ ফলকগুলোতে বিভিন্ন চিত্রকর্ম দেখা যায়। প্রাসাদটিতে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকেও প্রবেশপথ রয়েছে। প্রাসাদের অভ্যন্তরের বড় কক্ষটির মাঝখানে ১টি ঝর্ণা রয়েছে । ঝর্ণার চতুর্দিকে ব্যবহার করা হয়েছে মার্বেল পাথর এবং ছাদ (ceiling) থেকে ঝুলন্ত সম্প্রসারিত কাঁচের ঝাড়বাতি (chandeliers) রয়েছে। প্রাসাদের বাহির দেয়াল অন্যান্য অলংকরণের সাথে করিন্থিয়ান স্তম্ভ (corinthian column) দিয়ে সজ্জিত রয়েছে। প্রাসাদটির ছাদের উপরে চারদিকবেষ্টিত রয়েছে অলংকৃত উঁচু প্রাচীর (parapet)।

ময়মনসিংহ রাজবাড়িস্থ শশী লজের দক্ষিণ দিকে রয়েছে ১টি পুকুর। পুকুরটির উত্তরপাড়ে রয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট এবং দোতলা জলটুংগি বা স্নানাগার।

ঐতিহাসিক বিবরণ: খ্রিস্টীয় ১৯ শতকের শেষভাগে মুক্তাগাছার জমিদার বংশের উত্তরসূরী সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী একটি বিলাসবহুল দ্বিতল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সূর্যকান্ত আচার্যের দত্তক পুত্র শশীকান্তের নামানুসারে ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ প্রাসাদটির নামকরণ করা হয় শশী লজ। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন সংঘটিত ৮.৭ মাত্রার এক ভূমিকম্পে সূর্যকান্তের সুবিশাল রাজপ্রাসাদ শশী লজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯০৫ হতে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী একই স্থানে নতুন করে বর্তমানের দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটি নির্মাণসহ জমিদার বাড়ির সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শশী লজকে ময়মনসিংহ মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শশী লজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের ১টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এখানে স্থাপন করা হয়েছে ময়মনসিংহ জাদুঘর (museum)।
তথ্যসূত্র:
১. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
২. শ্রী কেদারনাথ মজুমদার প্রণীত ময়মনসিংহের বিবরণ (১৩১১ বঙ্গাব্দ) ও ময়মনসিংহের ইতিহাস (১৩১২ বঙ্গাব্দ)।
৩. Ahmed, Nazimuddin, Buildings of British Raj in Bangladesh, 1986, The University Press Limited(UPL), Page 87-89.
৪. বাংলাদেশের স্থাপত্যিক পুরাকীর্তির উপর ভূমিকম্পের প্রভাব এবং প্রতিরোধ
লেখক (author): সাবিনা ইয়াসমিন, ফিল্ড অফিসার/কাস্টোডিয়ান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।