সুনামি (Tsunami): এর কারণ ও সৃষ্টির পদ্ধতি
জাপানী শব্দ ‘সুনামি’ (Tsunami) এর ‘সু’ (Tsu) অর্থ ‘পোতাশ্রয়’ (harbour) এবং ‘নামি’ (nami) অর্থ ‘তরঙ্গ’ বা ‘ঢেউ’। ‘সুনামি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল পোতাশ্রয়ের ঢেউ। যার ভাবার্থ হল সমুদ্রের উপকূলের পোতাশ্রয় ধ্বংসকারী বিশাল আকারের তরঙ্গ বা ঢেউ। সমুদ্রের উপকূলে অথবা তলদেশে ভূমিকম্প কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সমুদ্রের পানিতে আন্দোলনের (movement) সৃষ্টি হয়। পানিতে সৃষ্টি এ আন্দোলনের কারণে যে বিশাল আকারের সমুদ্র তরঙ্গ বিপুল শক্তি নিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে তাকে সুনামি (Tsunami) বলে। সুনামির ফলে উপকূল অঞ্চলে ধনসম্পদ ও জনবসতির ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়, বিশেষ করে পোতাশ্রয় বা জেটির ক্ষতি হয়ে থাকে। কারণ পোতাশ্রয়গুলো স্থলভাগের প্রান্তদেশে সমুদ্রের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে।

সুনামির কারণ: সুনামি সৃষ্টির সাধারণ কারণ হিসেবে কিছু বিক্ষিপ্ত ও স্থানীয় ঘটনাকে দায়ী করা হয়। তবে সুনামি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হল ভূ-গাঠনিক (geo-tectonic) অবস্থা ও প্রক্রিয়া। সুনামির সৃষ্টির জন্য দায়ী উল্লেখযোগ্য কারণসূমহ নিম্নে উপস্থাপন করা হয়েছে।
(১) ভূমিকম্পজনিত সুনামি: পৃথিবীর ভূ-ত্বক গঠনকারী পাত বা ফলকগুলোর (plates) সঞ্চালনের ফলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। দুটি পাত (plates) যখন একে অপরের দিকে একই সীমারেখা বরাবর অগ্রসর হয়, তখন সে অবস্থাটিকে পাতের সংকোচন গতি বা অভিসারী বলে। পাতগুলোর অভিসারীর সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূমিকম্পের অধিকাংশ কেন্দ্রগুলো অবস্থিত। জানা যায়, এ ধরনের পাত সঞ্চালনজনিত ভূমিকম্পের কারণে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে সুমাত্রার উপকূলে সুনামি ঘটেছিল। ইন্ডিয়ান পাতের (plate) ও বার্মা (মায়ানমার) পাতের (plate) সংঘর্ষের ফলে ৮.৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়। ফলে আরও জানা যায়, ১৭৭১ সালে জাপানের এবং ১৯৬৪ সালে আলাস্কার ভূমিকম্পের ফলে সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল।

(২) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতজনিত সুনামি: উপকূলবর্তী এলাকায় পানির গভীরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সমুদ্রের পানিতে বিপুল আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন তরঙ্গের আকারে বিশাল এলাকা জুড়ে সমুদ্র উপকূলে আছড়ে পড়ে। ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয় দ্বীপ ক্রাকাতুয়া (Krakatau) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল।
(৩) ধস ও হিমানী সম্প্রপাতজনিত সুনামি: সুনামি সৃষ্টির কারণ হিসেবে ভূমি ধস ও হিমানী সম্প্রপাতের মত ঘটনাও দায়ী। যে কোন বদ্ধ জলাশয়ে ও হ্রদ এলাকায় ভূমি ধস, হিমানী সম্প্রপাত, ও উল্কাপাত হলে সে জলাশয়ে ও হ্রদে সুনামির সৃষ্টি হতে পারে।
সুনামি সৃষ্টির পদ্ধতি (Mechanism of Tsunami formation): ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের পানিতে আন্দোলনের (movement) সৃষ্টি হয়। সে আন্দোলনটি তরঙ্গের আকারে ঘণ্টায় প্রায় ৭০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার বেগে ক্রমশ উপকূলের দিকে ধাবিত হয়। পানির গভীরতার উপর সুনামি তরঙ্গের গতিবেগ নির্ভরশীল।
G. B. Airy প্রবর্তিত সূত্র অনুযায়ী–
গভীর সমুদ্রের তরঙ্গের বেগ V0 = gT/2π
এখানে, T = তরঙ্গের সময় (wave time)
G = অভিকর্ষজ ত্বরণ (9-81m/sec2)
অগভীর সমুদ্রের তরঙ্গের বেগ V = √gd, এখানে, d = পানির গভীরতা।



সুনামি উপকূলের দিকে আসার সাথে সাথে এর তরঙ্গের বেগের কতিপয় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পরিবর্তনগুলো হল-
(১) অগভীর সমুদ্রে তরঙ্গের বেগ পানির গভীরতার উপর নির্ভরশীল। পানির গভীরতা কমার সাথে সাথে তরঙ্গের গতিবেগ ক্রমশ কমতে থাকে। উপকূলের কাছে তরঙ্গের গতিবেগ কমলেও প্রচুর পানি ক্রমশ একত্রিত হয়ে তরঙ্গের উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়। তরঙ্গের এ উচ্চতা সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
(২) অগভীর সমুদ্রে তরঙ্গের দৈর্ঘ্যও পানির গভীরতার উপর নির্ভরশীল। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য L = T√gd, এখানে ‘L’ = তরঙ্গ দৈর্ঘ্য, ‘g’ = অভিকর্ষজ ত্বরণ এবং ‘d’ = পানির গভীরতা। যতই পানির গভীরতা কমতে থাকে, ততই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমতে থাকে।
(৩) তরঙ্গের ঢাল আবার তরঙ্গের উচ্চতা (H) ও তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের (L) উপর নির্ভরশীল। অগভীর সমুদ্রে সুনামি ক্রমশ উপকূলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় তরঙ্গ উচ্চতা বাড়তে থাকলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমতে থাকে এবং তরঙ্গের ঢাল বাড়তে থাকে। এক সময় এ তরঙ্গ প্রবল শক্তিতে উপকূলের উপর আছড়ে পড়ে। [মো: শাহীন আলম]
সহায়িকা: সহায়িকা: রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭-২০১৮), প্রাকৃতিক ভূগোল, কবির পাবলিকেশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২১৩-২১৪।