অর্থ বা মুদ্রা কি ও বিভিন্ন ধরনের অর্থ বা মুদ্রার ধারণা

অর্থ বা মুদ্রার ধারণা:

সাধারণভাবে বিনিময়ের মাধ্যমকে অর্থ বা মুদ্রা (money) বলে। অর্থ এমন একটি জিনিস, যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সকলেই গ্রহণ করতে রাজি থাকে এবং যা দিয়ে সকল প্রকার লেনদেন সম্পন্ন করা হয়। এক সময় মানুষ দ্রব্যের মাধ্যমে তাদের দৈনন্দিন লেনদেন করতো। কিন্তু দ্রব্যের মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতো। এ সকল সমস্যা দূর করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য লেনদেনের মাধ্যম মানুষ খুঁজে বের করতে শুরু করে। মানুষের এই প্রচেষ্টার ফলই হলো অর্থ। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ অর্থের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে অর্থের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো।

অর্থনীতিবিদ ক্রাউথার বলেন, “অর্থ এমন একটি জিনিস, যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং যা মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে।”
অর্থনীতিবিদ Sayers বলেন, “যে বস্তু দেনাপাওনা মিটাবার কাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় তাকে অর্থ বলা হয়।”
অর্থনীতিবিদ Walker এর মতে, “অর্থ যা করে তাই অর্থ।”
অর্থনীতিবিদ Robertson বলেন, “দ্রব্যসামগ্রীর দাম অথবা অন্যান্য ব্যবসায়গত কার্যকলাপের পাওনা হিসেবে যা সাধারণত সর্বত্র গ্রহণযোগ্য তাই অর্থ।”
অর্থনীতিবিদ Cole বলেন, “অর্থ এমন একটি জিনিস, যা সকলেই সাধারণভাবে দেনাপাওনা মিটাতে এবং ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করে।”
অর্থনীতিবিদ Knapp এর মতে, “যে বস্তু ঋণ পরিশোধের জন্য আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য তাকেই অর্থ বলা হয়।”
অর্থনীতিবিদ J. M. Keynes বলেন, “যে বস্তু হস্তান্তর করে ঋণ ও দামের চুক্তি মিটানো যায় এবং যার মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা যায় তাকেই অর্থ বলে।”
সুতরাং যে বস্তু বিনিময়ের মাধ্যম এবং দেনাপাওনা মেটানোর উপায় হিসেবে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং যা মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে তাকেই অর্থ বা মুদ্রা বলা হয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের অর্থ প্রচলিত আছে। আবার দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন প্রকারের অর্থ বা মুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়। নিম্নে বিভিন্ন ধরনের অর্থ বা মুদ্রার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো:

১। হিসাবগত মুদ্রা (money of account): অর্থের যে নাম বা উপাধিতে দেশের যাবতীয় হিসাব নিকাশ ও লেনদেন চলে তাকে হিসাবগত মুদ্রা বলা হয়। যেমন- বাংলাদেশের টাকা, ভারতের রুপি, আমেরিকার ডলার, ব্রিটেনের পাউন্ড, কুয়েতের দিনার ইত্যাদি হিসাবী মুদ্রার উদাহরণ।

২। প্রকৃত মুদ্রা (actual money): বাস্তব জীবনে যে অর্থের মাধ্যমে লেনদেনের কাজ সম্পাদন করা হয়, তাকে প্রকৃত মুদ্রা বলা হয়। যেমন- ১ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রচলিত সকল ধাতব মুদ্রা ও কাগজি নোটকে প্রকৃত মুদ্রা বলা যায়।

৩। বিহিত মুদ্রা (legal money): যে অর্থ সরকারের আইনগতভাবে স্বীকৃত এবং লেনদেন ক্ষেত্রেও জনসাধারণ ব্যবহার করতে বাধ্য থাকে, তাকে বিহিত মুদ্রা বলা হয়। যেমন- বাংলাদেশে প্রচলিত ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ইত্যাদি কাগজি নোট ও বিভিন্ন প্রকার ধাতব মুদ্রা হলো বিহিত মুদ্রা।

৪। ঐচ্ছিক মুদ্রা (optional money): যে অর্থ জনগণ লেনদেনের কাজে ব্যবহার করতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়, তবে প্রয়োজনে লেনদেনের কাজে সহায়তা করে, তাকে ঐচ্ছিক মুদ্রা বলা হয়। যেমন- ব্যাংকের চেক, প্রাইজবন্ড, ইত্যাদি।

৫। প্রামাণিক মুদ্রা (standard money): যে মুদ্রার দৃশ্যমান মূল্য এবং বাস্তব মূল্য পরস্পর সমান হয়, তাকে প্রামাণিক মুদ্রা বলা হয়। অর্থাৎ, প্রামাণিক মুদ্রা গলানোর মাধ্যমে যে ধাতু পাওয়া যায়, তার মূল্য মুদ্রার মূল্যের সমপরিমাণ হবে।

৬। প্রতীক মুদ্রা (token money): যে ধাতব অর্থের গায়ে লিখিত মূল্য তার অন্তর্নিহিত মূল্যের চেয়ে কম হয় তাকে প্রতীক মুদ্রা বলা হয়।
৭। আদিষ্ট মুদ্রা (fiat money): সামষ্টিক অর্থনীতি, যে অর্থ সরকারের নির্বাহী আদেশের কারণে জনগণ লেনদেনের কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, কিন্তু এ ধরনের অর্থের নিজস্ব কোন নির্দিষ্ট মূল্য নেই, তাকে আদিষ্ট মুদ্রা হয়। যেমন- সরকারি আদেশে দেশে প্রচলিত কাগজি নোটসমূকে আদিষ্ট মুদ্রা বলা যায়।

৮। ব্যাংক অর্থ (bank money): বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করার জন্য ব্যাংকসমূহ যে সব ঋণপত্র ইস্যু করে, সেগুলোকে ব্যাংক অর্থ বলা হয়। যেমন- ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, চেক, ইত্যাদি।

৯। প্রায় মুদ্রা (near money): যে সকল সম্পদ সরাসরি লেনদেন কাজে ব্যবহার করা যায় না তবে চাইলে সহজেই অর্থে রূপান্তর করা যায়, সেগুলোকে প্রায় মুদ্রা বলা হয়। যেমন- ট্রেজারি বিল, চাহিদা আমানত, প্রাইজবন্ড, সরকারি বন্ড, ইত্যাদি।

১০। সংকীর্ণ মুদ্রা (narrow money): সংকীর্ণ মুদ্রা বলতে ব্যাংক বহির্ভূত অর্থ, অর্থাৎ জনগণের হাতের নগদ অর্থ এবং তফসিলী ব্যাংকে রক্ষিত চাহিদা আমানতের সমষ্টিকে বুঝায়। অর্থাৎ M1 = CU+ DD
যেখানে M1 = সংকীর্ণ মুদ্রা;
CU = জনগণের কাছে রক্ষিত অর্থ এবং
DD = ব্যাংকের চাহিদা আমানত। সংকীর্ণ মুদ্রার তারল্য সাধারণত বেশি থাকে।

১১। বিস্তৃত/ প্রশস্ত মুদ্রা (broad money): সংকীর্ণ মুদ্রা এবং ব্যাংকের মেয়াদী আমানতের যোগফলকে বিস্তৃত মুদ্রা বলা হয়। অর্থাৎ M2 = M1 + TD
যেখানে, M2 = বিস্তৃত মুদ্রা;
TD = তফশিলী ব্যাংকের মেয়াদী আমানত। [শারমিন জাহান সায়মা]


সহায়ক বই: ইসলাম, ড. নুর; খায়ের, আবুল, ২০২২, সামষ্টিক অর্থনীতি, ঢাকা: দি ইউনাইটেড পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৩৪-২৩৬।


Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL


Leave a Reply