আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি

শ্রম বিভাগ ও বিশ্লেষীকরণের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব বলা যায়, বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের সমৃদ্ধিগত ও উৎপাদনগত ক্ষমতার পার্থক্য থেকেই মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তথা বিশ্ব বাণিজ্য প্রথার প্রবর্তন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্ভবের উল্লিখিত কারণসমূহ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

১. উৎপাদনের উপকরণসমূহের গতিশীলতা (mobility of the means of production): উৎপাদনের উপকরণসমূহের (যেমন- ভূমি, শ্রম, পুঁজি, প্রযুক্তি, সংগঠন প্রভৃতি) গতিশীলতার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশে দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনে আপেক্ষিক সুবিধা বা ব্যয় পার্থক্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে। অধ্যাপক এ্যাডাম স্মিথ (Prof. Adam Smith) মন্তব্য করেছেন, “Of all sort of luggage man is the most difficult to be transported.” (অর্থাৎ উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের মধ্যে শ্রম সর্বাপেক্ষা গতিহীন উপাদান)। ফলে একেক দেশ একেক পণ্য অপেক্ষাকৃত সুবিধার সাথে উৎপাদনে সমর্থ হয়, এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্ভব ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়।

২. জলবায়ুর তারতম্য (climate variation): জলবায়ুর তারতম্য তথা জলবায়ুগত পরিবেশের প্রভাবে পৃথিবীর সকল দেশে সকল ধরনের দ্রব্য ও সেবা সমান দক্ষতার সাথে উৎপাদন করা সম্ভবপর হয় না। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু থাকায় এক অঞ্চল একটি বিশেষ পণ্য উৎপাদনে পারদর্শী হয়ে থাকে। জলবায়ুগত তারতম্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৩. মানবীয় দক্ষতা (human skills): মানবীর দক্ষতা ও গুণাগুণের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কার্যত পৃথিবীর জনগণের কর্ম দক্ষতা, কর্ম পারদর্শিতার কারণে দ্রব্য সেবা উৎপাদনে শ্রমের বিশেষায়ন ঘটে, ফলে দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে একেক দেশে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে।

৪. শ্রমের বিশেষায়ন (labour specialization): নানাবিধ অনুকূল প্রাকৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিদ্যমান থাকায় পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে বা দেশবিশেষ কোনো পণ্য উৎপাদনের সুবিধা বিদ্যমান থাকায় ঐ অঞ্চল বা দেশ ঐ বিশেষ পণ্য উৎপাদনে পারদর্শিতা বা বিশেষজ্ঞতা অর্জন করে। বিশেষ পণ্য উৎপাদনে তাদের বিশেষায়িত জ্ঞানের কারণে তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বল্প ব্যয়ে ঐ পণ্য উৎপাদন করতে পারে। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তাদের থেকে পণ্য ক্রয়ে উপকৃত হয়। এভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ সুগম হয়।

৫. প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা (abundance of natural resources): পৃথিবীর একেক দেশ একেক ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। যে দেশ যে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, সে দেশ সে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে নানা শিল্প কারখানা স্থাপন করে তুলনামূলক সুবিধায় পণ্য দ্রব্যাদি উৎপাদন করে বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ খনিজ তৈল সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্বালানি তৈল রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিকাশ সাধন করেছে।

৬. অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবণতা (trends in economic development): অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবণতাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্ভবের একটি বিশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কার্যত যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং যে দেশের সার্বিক কার্যক্রম অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিয়ে সে দেশের বাণিজ্য নীতি হবে প্রসারিত এবং সম্প্রসারিত। পক্ষান্তরে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রতি অনেকটাই বিপরীতমুখী। তাই বলা যায় সুদৃঢ় অর্থনৈতিক অবস্থায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবণতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সহায়ক এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরির একটি বিশেষ কারণ।

৭. বাজার ব্যবস্থা (market system): পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণে বিবিধ বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যেমন- ধনতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থা, সংরক্ষিত বাজার ব্যবস্থা, মুক্ত বাজার ব্যবস্থা, মিশ্র বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি। ফলে বাজার ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে পণ্য ও সেবার উৎপাদন কম বেশি হয়ে থাকে, যা লেনদেনে প্রতিফলিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, বাজার ব্যবস্থার কারণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সৃষ্টি এবং সম্প্রসারিত হয়ে থাকে।

৮. মূলধন ও মূলধনীয় উপকরণের সহজলভ্যতা (availability of capital and capital equipment): মূলধন ও মূলধনীয় উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে পৃথিবীর দেশসমূহ পণ্য ও সেবার উৎপাদনে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। যে সকল দেশসমূহে সহজে এবং সুলভে মূলধন ও মূলধনীয় উপকরণ পাওয়া যায়, সে সব দেশসমূহ সহজে সমৃদ্ধিশীল হয়ে উঠতে সক্ষম।

৯. বাণিজ্যিক জোট ও চুক্তি (commercial alliance and agreement): বিশ্বায়নের এ যুগে বিভিন্ন দেশ পারস্পরিক স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় অনন্যতা, সমরূণ রাজনৈতিক দর্শন ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন সামরিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক জোট ও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। বাণিজ্যিকভাবে জোটবদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ অনেক সময় চুক্তির শর্ত মোতাবেক নিজেদের মধ্যে নিজেদের সুবিধানুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় করে। ফলে উদ্ভব ঘটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের। যেমন- নাফটা (NAFTA), গ্যাট (GATT), সাপটা (SAPTA) ইত্যাদি চুক্তি ও জোটসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ নিজেদের মধ্যে সুবিধানুযায়ী পণ্য দ্রব্য বিনিময় করে।

১০. পণ্যের মানগত পার্থক্য (difference in the quality of product): শ্রমের বিশেষায়ন, প্রযুক্তি উৎকর্ষতা, গুণগত কাঁচামালের ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য ব্য উৎপাদনে সক্ষম হয়। আবার কোথাও কোথাও এরূপ মানসম্মত পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শ্রেণির ভোক্তাদের চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংঘটিত হয়।

১১. উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন (invention of high technology): বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা, উন্নয়ন, প্রয়োজনীয়। তহবিল ইত্যাদির মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ আজ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের শীর্ষে অবস্থান করলেও উন্নয়নশীল অনুন্নত দেশসমূহ যথাযথ প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখনও বহু পিছিয়ে রয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এসব দেশসমূহ প্রত্যক্ষ মূল্যের বিনিময়ে অথবা উন্নত দেশসমূহের সাথে যৌথ উদ্যোগে নিজ দেশে শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি নিজ দেশে আমদানি করে।

১২. অর্থনৈতিক জাতীয়তাবোধ (economic nationalism): প্রতিটি দেশের একটি নিজস্ব ও অর্থনৈতিক সত্ত্বা রয়েছে। প্রতিটি দেশের সরকার সার্বভৌম ও স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণের পক্ষপাতি। এজন্য দেশের উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, বিনিময়, মূলধন গঠন, বিনিয়োগ নীতি ইত্যাদির বিষয় জাতীয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়। কাজেই জাতীয় সরকারই সিদ্ধান্ত নেয় কী পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করবে? অথবা কী পরিমাণ আমদানি করবে? ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতি প্রকৃতি বিভিন্ন দেশের সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। [শারমিন জাহান সায়মা]


কেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠিত হয়?
✅ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠনের কারণ।
✅ Economic Basis of International Trade.
Causes of Occuring International Trade.


সহায়িকা: জোয়ারদার, সুকেশ চন্দ্র; আলম, মোঃ শাহ; আখতার, সুফিয়া ও ইসলাম, মোঃ নজরুল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, (২০২০), মিলেনিয়াম পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply