ঈদের ইতিহাস: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা

‘‘ঈদ” – শব্দটির অর্থ ‘উদযাপন’ বা ‘উৎসব’। এটি ইসলামের একটি মর্যাদাপূর্ণ শব্দ। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর নির্দেশনা অনুসারে মুসলমানদের ঈদ উদযাপনের জন্য ইসলামে উৎসর্গীকৃত দুটি সময় রয়েছে। দুটি আলাদা সময়ে উদযাপিত ঈদ দুটি হলো: ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। ঈদগুলো হলো এমনি সময়, যখন আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) তাঁর বান্দাদের খুশিতে আনন্দিত হন এবং সকলের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করেন।
কেউ কেউ ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্ত হন। তবে এ দুটি উৎসবই পৃথকভাবে উদযাপন করা হয় এবং উভয়ের তাৎপর্য ও অর্থের ভিন্নতা রয়েছে। দুটি উৎসব একইভাবে উদযাপিত হয়, তবে এ উৎসব দুটি আলাদা আলাদা বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঈদ কি?
‘‘ঈদ” – বলতে আনন্দ উদযাপনের একটি সময়কে বোঝায়। ঈদ প্রধানত দুই প্রকার; যেমন: (১) ঈদ-উল-ফিতর (ঈদুল ফিতর), এ ঈদকে কখনও কখনও ‘ছোট ঈদ’ বলা হয় এবং (২) ঈদ-উল-আযহা (ঈদুল আযহা), এ ঈদকে কখনও কখনও ‘বড় ঈদ’, ‘কোরবানি ঈদ’, ‘বকরা ঈদ’ বা ‘ঈদ আল-কবীর’ বলাও হয়।
কখন ঈদ উদযাপন করা হয়?
‘কখন ঈদ উদযাপন করা হয়?’ প্রশ্নটি নির্ভর করে, আমরা কোন ধরনের ঈদের কথা বলছি, তার উপর। আমরা যদি মনে করি, রমজানের পরে কোনো ঈদ, সেটা হলো ঈদুল ফিতর। যারা ইসলামকে অনুসরণ করে না, তাদের মধ্যে ঈদ দুটিরও বেশি হতে পারে। তবে ইসলামের নিয়ম অনুসারে ঈদ সাধারণত দুই সময়ে উদযাপন করা হয়।
ঈদুল ফিতর কখন উদযাপন করা হয়?
রমজান মাসের পরে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। রমজান হলো ইসলামিক (চন্দ্র) ক্যালেন্ডারের নবম মাস। তার মানে, ঈদুল ফিতর আসে ঈদুল আযহার আগে। তাই ঈদুল ফিতর হলো মুসলমানদের প্রথম ঈদ। রমজান মাসের শেষ দশদিন এক হাজার মাসের মূল্যবান আশীর্বাদ বা কল্যাণ নিয়ে আসে। তাই, ঈদ উদযাপনের চেয়ে রমজান মাসের উপবাস (রোজা) এবং প্রার্থনা ও দান-খয়রাত করার চেয়ে ভালো সময় ও উপায় আর নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে, ইসলামিক (চন্দ্র) বছরের দশম মাসে অর্থাৎ শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়।
ঈদুল ফিতর কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ঈদুল ফিতর খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। কারণ এটি সবচেয়ে পবিত্র রমজান মাসে উপবাস (রোজা) এবং প্রার্থনা ও দান-খয়রাত করার পরে উদযাপন করা হয়। রমজান মাস হলো আল্লাহর সাথে মুসলমানদের বন্ধন দৃঢ় করার, কুরআন তেলাওয়াত করার এবং মহান ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করার সময়। এর প্রতিদান হিসেবে উদযাপন করা হয় ঈদুল ফিতর।
ঈদুল ফিতর কত দিন উদযাপন করা হয়?
ঈদুল ফিতর মাত্র একদিন স্থায়ী হয়, যা ইসলামিক (চন্দ্র) বছরের দশম মাসের অর্থাৎ শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে এদিনটি জাতীয় ছুটির দিন।
ঈদুল আজহা কখন উদযাপন করা হয়?
কোরবানি বা ঈদুল আযহা হলো মুসলমানদের জন্য বছরের অন্যতম পবিত্র সময় এবং ইসলামিক (চন্দ্র) বছরের দ্বাদশ মাসে উদযাপন করা হয়। কোরবানি করার জন্য ঈদুল আযহার নামাজ অবশ্যই আদায় করতে হবে। ঈদুল আযহার দিনটি ঈদুল ফিতরের পরে আসে, ঈদুল আযহা উদযাপন করা হয় জিলহজ্ব মাসে।
উল্লেখ্য যে, চন্দ্রচক্রের উপর ভিত্তি করে ইসলামিক ক্যালেন্ডারের হওয়ায়, প্রতি বছর উভয় ঈদের তারিখ পরিবর্তন হয়, প্রতি বছর প্রায় ১০/১১ দিন আগে ঈদ উদযাপন করা হয়।
ঈদুল আযহা কত দিন উদযাপন করা হয়?
ঈদুল আযহা উদযাপন সাধারণত তিন দিন স্থায়ী হয়। ইসলামিক (চন্দ্র) বছরের দ্বাদশ মাসে অর্থাৎ জিলহজ্ব জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত তিন দিন ধরে ঈদুল আযহার কোরবানি চলে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ঈদুল আযহায় জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
ঈদের শুভেচ্ছা
মুসলমানগণ একে অপরকে পবিত্র ঈদের দিনে শুভেচ্ছা জানান। “ঈদ মুবারক” হলো ঈদের সাধারণ শুভেচ্ছা। এ শুভেচ্ছা উক্তিটি ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা উভয় ঈদেই ব্যবহৃত হয়। তবে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আমরা বলতে পারি “ঈদ-উল-ফিতর মুবারক” কিংবা “ঈদ-উল-আযহা মুবারক”। তবে বছরের দুটি ঈদের শুভেচ্ছা উক্তি হিসেবে, “ঈদ মুবারক” হলেই চলে।
ঈদের ইতিহাস
ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনাতে হিজরত করার পরেই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়৷ হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায় যে, নবী করিম (সাঃ) মদিনা আগমন করে দেখলেন মদিনাবাসীগণ দুই দিবসে আনন্দ উল্লাস করছে৷ মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এ দিবস দুটি কি? মদিনাবাসীগণ বললেন, জাহেলী যুগ থেকে পালিত উৎসব, আমরা এ দুটি দিবসে আনন্দ ও উল্লাস করে থাকি৷ তখন মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে উক্ত দিবস দুটির পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন৷ দিবস দুটি হলো ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর৷ (সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুল ঈদায়ন)’’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পারসিক প্রভাবে শরতের পূর্ণিমায় নওরোয নামে এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মিহিরজান নামে উৎসব দুটিতে মদিনাবাসীগণ বিভিন্ন ধরনের আনন্দ-উল্লাস, খেলাধুলা ও কুরুচিপূর্ণ রং তামাশার মাধ্যমে উদযাপন করতো৷ উৎসব দুটির আচার-ব্যবহার, ও রীতি-নীতি ছিল ইসলামের আদর্শ পরিপন্থী৷
জরথুস্ত্র প্রবর্তিত নওরোয ছিল নববর্ষের উৎসব৷ তবে এটি ছয়দিন ব্যাপী উদযাপিত হতো। এর মধ্যে শুধু একটি দিবস নওরোয-এ-আম্মা বা কুসাক ছিল সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট৷ অন্যান্য দিনগুলো ছিল সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্তের ব্যক্তিবর্গের জন্য সুনির্দিষ্ট৷ একইভাবে ছয় দিনব্যাপী মিহিরজান অনুষ্ঠানের শুধু একটি দিন সাধারণ, ও দরিদ্র মানুষজন উপভোগ করতে পারতো৷ এ দুটি উৎসব ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য, শ্রেণি বৈষম্য, ঐশ্বর্য-অহমিকা ও অশালীনতার পরিপূর্ণ প্রকাশে কলুষিত ছিল৷
ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসীগণ ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নির্দেশে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উৎসব উদযাপন করা শুরু করলো৷
ইতিহাস (ঈদুল আযহা)
ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নবী ও রাসূল হযরত ইব্রাহীম‘কে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বলেন: “তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো।”
হযরত ইব্রাহীম স্বপ্নে এরূপ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ঐ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং তখন ইব্রাহীম শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত তিনটি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
যখন ইব্রাহীম আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য পুত্র ইসমাইলের গলায় ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে, তার পুত্রের পরিবর্তে একটি পশু কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এটি ছিল ছয় সংখ্যক পরীক্ষা। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ ইব্রাহীম’কে তার খলিল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেন।
এ ঘটনাকে স্মরণ করে, সারা বিশ্বের মুসলিমগণ আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এ দিবসটি উদ্যাপন করে। ইসলামিক (চন্দ্র) বছরের বা হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসেবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত তিন দিন ধরে ঈদুল আযহার কুরবানি চলে। চান্দ্র বছরের গণনা অনুসারে, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সর্বোচ্চ ৭০ দিন হয়।
ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার মধ্যে যোগসূত্র কি?
ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা দুই ঈদের অর্থ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও, উভয়ই দান-খয়রাত ও ত্যাগের দ্বারা একত্রিত হয়। রমজানের শেষে ঈদুল ফিতরের সময় যাকাত ও ফিতরা দেয়া হয় এবং যারা ক্ষুধার্ত তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়।
ঈদুল আযহায় কোরবানিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এ ঈদে পশু কোরবানি করা হয়। তারপর কোরবানিকৃত পশুকে তিনটি ভাগে ভাগ করে এর একটি অংশ দরিদ্র্যদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।
ত্যাগ ও দানের চেতনা ইসলামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা আমাদের প্রতি আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) ভালবাসার একটি বহি:প্রকাশ। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহায় বিশ্বজুড়ে আমাদের ভাই ও বোনদের সাথে ভালোবাসা, ত্যাগ ও দানের চেতনাসহ উদযাপন করতে পেরে আমরা সৌভাগ্যবান। [সংকলিত]
তথ্যসূত্র:
১। Eid-ul-Fitr and Eid-ul-Adha – What is the Difference?, muslimaid.org
২। ঈদ, wikipedia.org
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL