উৎপাদন এবং উৎপাদনের উপকরণ
উৎপাদন কী?
সাধারণত ‘উৎপাদন’ বলতে কোন দ্রব্য সৃষ্টি করাকে বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে ‘উৎপাদন’ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে কোনো দ্রব্যের উপযোগ সৃষ্টি করাকে বুঝায়। কারণ, মানুষ প্রকৃতপক্ষে কোনো দ্রব্য সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষের চারপাশে যা কিছু রয়েছে, তা সবই প্রকৃতির দান। মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত এসব দ্রব্যের আকৃতি, রূপ বা আয়তন পরিবর্তন করে নতুন উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন- কাঠ হতে আসবাবপত্র তৈরি করে মানুষ কোনো নতুন জিনিস সৃষ্টি করে না; বরং কাঠের আকার পরিবর্তন করে নতুন উপযোগ সৃষ্টি করে। অনুরূপভাবে, কৃষক বীজ হতে ফসল উৎপাদন করে; তাঁতি তুলা হতে কাপড় উৎপাদন করে। এসব দ্রব্যের বস্তুভাগ প্রকৃতির দান। মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত বস্তুর সাথে নিজের শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করে অধিকতর উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
অধ্যাপক মার্শাল বলেন, ‘এ বস্তু জগতে মানুষ কেবল বস্তুকে পুনর্বিন্যাস করে তাকে অধিকতর ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে পারে।’
ডানিয়াল বি. সুইটস এর মতে, ‘উৎপাদন হলো এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির দেয়া বস্তু ভোগের উপযোগী করে তুলতে পারে।’
সুতরাং অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে কোনো দ্রব্যের উপযোগ বা কাম্যতা সৃষ্টি করাকে বুঝায়।
উৎপাদনের উপকরণ:
বিভিন্ন প্রকারের জিনিস উৎপাদন করতে যেসব দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের প্রয়োজন সেগুলোকে যৌথভাবে উৎপাদনের উপকরণ বলা হয়। বিভিন্ন জিনিস উৎপাদন করতে অসংখ্য উপকরণের প্রয়োজন হয়। যেমন – আলো, বাতাস, তাপ, মাটির উর্বরতা, শারীরিক ও মানসিক শ্রম, বুদ্ধিমত্তা, সাংগঠনিক দক্ষতা, খনিজ, বনজ ও জলজ সম্পদ, প্রাণীজ সম্পদ, যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি অসংখ্য জিনিসের প্রয়োজন হয়। এসব উপকরণগুলোকে আলোচনা ও নিয়োগের সুবিধার্থে সমগুণ বা সমজাতীয়তার ভিত্তিতে গোষ্ঠী বা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেমন— (১) ভূমি, (২) শ্রম, (৩) মূলধন এবং (৪) সংগঠন।
১। ভূমি (land): ভূমি বলতে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগকে বুঝায় না। অর্থনীতিতে ভূমি বলতে জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে বিরাজমান সব প্রাকৃতিক সম্পদকে বুঝায়। অধ্যাপক মার্শালের মতে, ‘ভূমি বলতে জমিতে, পানিতে, বাতাসে, আলোয় এবং তাপে মানুষের সাহায্যের জন্য যে সব পদার্থ ও শক্তি প্রকৃতি মুক্ত হাতে দান করেছে তাদের সবকেই বুঝায়।’
২। শ্রম (labour): উৎপাদন কাজে নিয়োজিত মানুষের কায়িক ও মানসিক প্রচেষ্টাকে শ্রম বলে। সহজ অর্থে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ব্যবহৃত দৈহিক ও মানসিক শক্তিকেই শ্রম বলে। তবে কোনো শ্রমই সম্পূর্ণরূপে কায়িক ও মানসিক নয়। সব শ্রমই কিছু না কিছু কায়িক ও মানসিক। যেমন- শিক্ষকতা যদিও মানসিক শ্রম তবুও এতে কিছু শারীরিক ক্লেশ রয়েছে। চোরের বা ভিক্ষুকের শ্রম উপযোগীতা সৃষ্টি করে না বলে তা শ্রম নয়। আবার খেলাধুলা প্রদর্শন করে যারা অর্থ উপার্জন করে তাদের পরিশ্রম হলো শ্রম।
৩। মূলধন (capital): উৎপাদনের তৃতীয় উপাদান হলো মূলধন। মূলধন মানুষের তৈরি সম্পদের সে অংশ, যা অধিক উৎপাদনে সহায়তা করে। মিঃ বমবয়ার্কের মতে, ‘মূলধন হলো উৎপাদনের ফলে উৎপাদিত উপাদান।’ অর্থাৎ মানুষের পরিশ্রমের ফলে উৎপাদিত যে সব সম্পদ সরাসরি ভোগে ব্যবহৃত না হয়ে পুনরায় উৎপাদন কাজে নিযুক্ত হয়, তা মূলধন। এ অর্থে মূলধন বলতে যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, কাঁচামাল, বিদ্যুৎ ইত্যাদিকে বুঝায়। যেমন – লোহা ও ইস্পাত কারখানা মানুষেরই তৈরি এবং এরা আরও যন্ত্রপাতি তৈরিতে নিয়োজিত। অতএব, লোহা ও ইস্পাত কারখানা মূলধন। বর্তমান উৎপাদন পদ্ধতিতে মূলধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
৪। সংগঠন (organisation): উৎপাদনের জন্য ভূমি, শ্রম ও মূলধনের আনুপাতিক সংগ্রহ, সংযোজন ও উৎপাদনে নিয়োগ করার প্রচেষ্টা ও নিপুণতাকে সংগঠন বলে। সংগঠনের পক্ষে যিনি দায়িত্ব পালন করেন তাকে সংগঠক বলে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে সংগঠন বা ব্যবস্থাপনা খুবই জটিল ও ঝুঁকি বহুল হয়ে পড়েছে। তাই উৎপাদন বা ব্যবসায়ের সফলতা নির্ভর করে সংগঠনের নৈপুণ্যের উপর। ভূমি, শ্রম এবং মূলধনের মধ্যে সমন্বয় করে সেগুলো হতে উৎকৃষ্ট ফল বা উত্তম সেবা আদায় করতে পারলে উৎপাদন লাভজনক হবে। সাংগঠনিক ব্যর্থতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য উৎপাদন কাজ ব্যাহত হয়। উৎপাদনের আয়তন বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সংগঠনের কাজের দায়িত্ব ও গুরুত্ব বেড়ে যায়। [শারমিন জাহান সায়মা]
সহায়িকা: খায়ের, আবুল; ইসলাম, ড. নুর; (২০২২); ব্যষ্টিক অর্থনীতি; ঢাকা: দি ইউনাইটেড পাবলিশার্স; পৃষ্ঠা ৬৫ – ৬৬।
Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL