কালের সাক্ষী ছবি খাঁর হুজরা, পলাশীর যুদ্ধের কামান, সতীদাহ মঠ
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া গ্রামে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ইংরেজ বিরোধী পলাশীর যুদ্ধের কামানের ধ্বংসাবশেষ। তেমনি কালের সাক্ষী হয়ে বংকুরা গ্রামে দাঁড়িয়ে রয়েছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের কৃতীমান পুরুষ ছবি খাঁর হুজরা ও উত্তর শিহিপাশা গ্রামের সতীদাহ মঠ। যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও এসব ঐতিহাসিক নির্দশন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখনও নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কালের সাক্ষী এসব নির্দশনগুলো। রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।
ছবি খাঁর হুজরা: ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ গৌরনদীকে নিয়ে কবি সিকদার রেজাউল করিমের লেখা “বৃহতি গৌরনদী” বইতে একেক ভাষায় একেকটি ঘটনার উপস্থাপন করেছেন। একান্ত আলাপকালে কবি সিকদার রেজাউল করিমের দেয়া তথ্য ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৬শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের শাসন আমল থেকে পরবর্তী প্রায় ৬৬ বছর তৎকালীন বাকলায় (বর্তমান বরিশালে) মগ সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করেই স্থায়ীগণ বসবাস করে। জনশ্রুতি অনুসারে, তৎকালীন সময়ে মগের জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনসহ ত্রাসের রাজত্বে বাকলার আকাশে কোন পাখি পর্যন্ত উড়েনি। মোঘল সেনারাও অসংখ্যবার মগের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়।
সম্রাট আকবরের পরবর্তী সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে কিংকর ভূঁইয়ার পুত্র মদন মোহন ও ছবি খাঁকে বাকলার ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ছবি খাঁ বাকলার ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত হবার পর নিজের নেতৃত্বে নিজেই গড়ে তোলেন বিশাল সেনা সৈন্যের দল। একপর্যায়ে তিনি (ছবি খাঁ) মগের বিরুদ্ধে শেষবারের মত যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ছবি খাঁর সে যুদ্ধে বাকলা থেকে মগদের বিতারিত হতে হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কৃতীমান পুরুষ বাকলায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন।
ছবি খাঁর নামানুসারে অসংখ্য রাস্তা, জাঙ্গাল (বাঁধ), পুল, দিঘীসহ ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনো টিকে আছে। সূত্রমতে, কৃতীমান পুরুষ ছবি খাঁ শেষ বয়সে আধ্যাত্মিক সাধনা করার জন্য তৎকালীন জনমানব শূন্য নিরোবিছিন্ন বর্তমান বংকুরা গ্রামে হুজরা (ইবাদত খানা) নির্মাণ করে সৃষ্টিকর্তার অপারধ্যানে মগ্ন ছিলেন। বর্তমানে হুজরাকে সামনে রেখে স্থানীয়রা একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। ঐ মসজিদের ইমাম স্থানীয় আদেল উদ্দিন তালুকদার বলেন, কৃতীমান পুরুষ ছবি খাঁর হুজরাকে সামনে রেখে আমি মহান সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
পলাশীর যুদ্ধের কামানের ধ্বংসাবশেষ: ১৭৫৭ সালে ইংরেজ বিরোধী পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা শহীদ হবার পর তার পরাজিত সৈন্যরা জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিনের পরিচালনাধীন সরিকলের দূর্গে আশ্রয় নেন। অন্যান্য জমিদাররা ইংরেজদের সাথে আতাত করলেও তৎকালীন নাজিরপুর পরগনার (বর্তমান নলচিড়া) জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিন ইংরেজদের সাথে আতাত না করে তাদের (ইংরেজদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। একপর্যায়ে সরিকল নদীতে ইমাম উদ্দিনের সৈন্যদের সাথে ইংরেজ সৈন্যদের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে অনেক ইংরেজ সৈন্য নিহত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের পরেও মোগল নৌ-সেনাপতি উলফৎ গাজীর বংশধর জমিদার ইমাম উদ্দিন দীর্ঘ ২২ বছর নাজিরপুর পরগনার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ১৭৭৯ সালে সরিকল নদীতে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে জমিদারের সৈন্যদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে সরিকল দুর্গের পতনের পর ইংরেজ সৈন্যরা নলচিড়া মিয়াবাড়িতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিনও পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। একপর্যায়ে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিং সৈয়দ ইমাম উদ্দিনকে বন্দী করতে সক্ষম হন। সৈয়দ ইমাম উদ্দিনের সে যুদ্ধের কামানের ধ্বংশাবশেষ আজও কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
সতীদাহ মঠ: হিন্দু ধর্মের বেদ অনুসারে হাজার-হাজার বছর ধরে সতীদাহ প্রথা (স্বামী মারা গেলে তার সাথে জীবিত স্ত্রীকে শ্মশানে পোড়ায়ে দেয়া) বিধান প্রচলিত ছিল। এ প্রথার অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনামলে রাজা রাম মোহন রায় ও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগরের বিধান বলে। সতীদাহ ঘটনার ঐতিহাসিক নিদর্শন আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের উত্তর শিহিপাশা গ্রামে।
কবে কখন কোন সতী স্ত্রীকে স্বামীর সাথে ঐ শ্মশানে পোড়ায়ে দেয়া হয়েছে, তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও স্থানীয় সোহরাব হোসেন মলিক জানান, ঐ সম্পত্তির পূর্ব দলিল ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে এ বাড়িতে রুহিনী ঠাকুর নামের একজন বসবাস করতেন বলে পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, রুহিনী ঠাকুর অথবা তার পুর্ব পুরুষের কেউবা হয়তো সতীদাহ শ্মশানে কারুকার্য খচিত মঠটি নির্মাণ করেছেন।
ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বরিশালের গৌরনদীবাসী এসব ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। [সাংবাদিক এইচ এম লিজন]
কালের সাক্ষী ছবি খাঁর স্মৃতি নিদর্শন
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL