চোখের ছানি
চোখ হলো দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে সেরা সম্পদ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখে নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়। বাংলাদেশে ১১ প্রকার মারাত্মক চক্ষু রোগ তুলনামূলক বেশি ঘটতে দেখা যায়, এ রোগগুলো হলো ১. গ্লুকোমা; ২. মাইওপিয়া; ৩. চোখের মণিতে ঘা; ৪. অপুষ্টিজনিত কারণে অন্ধত্ব; ৫. রেটিনাল ডিটাচমেন্ট; ৬. ছানি পড়া; ৭. সময়মতো চশমা না নেওয়ার অন্ধত্ব; ৮. ট্যারা চোখ পরীক্ষা না করায় অন্ধত্ব; ৯. ব্লাড প্রেসারের কারণে চোখে প্রদাহ; ১০. চোখ লাল হওয়া; এবং ১১. ডায়বেটিসজনিত চক্ষুরোগ।
উল্লেখিত রোগের মধ্যে চোখে ছানি পড়া বাংলাদেশে চোখের মারাত্মক রোগ। এ দেশে বয়সকালে যত মানুষ অন্ধ হয়, তার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ হয় ছানি থেকে। এ রোগ সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পরে বেশি দেখা যায়।
চোখের ছানি কী?
আমাদের চোখের অভ্যন্তরে পরকলা/লেন্স (lens) নামক একটি অংশ আছে। এ লেন্সের মাধ্যমে বাহিরের যে কোনো বস্তুগত আলোকরশ্মি চোখের ভিতর প্রবেশ করে এবং চোখের ভিতরে অবস্থিত রেটিনা নামক স্থানে ঐ বস্তুর প্রতিবিম্ব তৈরী করে, ফলে উক্ত বস্তুকে আমরা দেখতে পাই, চোখের লেন্স বিভিন্ন উপাদানে গঠিত। এর মধ্যে প্রোটিন একটি অংশ। বৃদ্ধ বয়সে অনেক সময় এ প্রোটিন তার নিজস্ব গুণাবলী পরিবর্তন করে কিছুটা পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে। ফলে প্রোটিন কিছুটা জমাট বেঁধে গিয়ে লেন্সকে অস্বচ্ছ করে তোলে, ফলে স্বচ্ছ লেন্স দিয়ে যতটা সহজে আলোক রশ্মি চোখের ভিতরে প্রবেশ করে, অস্বচ্ছ লেন্স দিয়ে সেভাবে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে রেটিনার উপরও বস্তুর কোনও প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় না এবং যার কারণে আমরা চোখে দেখতে পাই না। এ অবস্থার সৃষ্টিকে বলা হয় চোখের ছানি (cataract)।
অনেকের ধারণা, ছানি বলতে চোখের মধ্যে পর্দা পড়া বুঝায়। তাই অনেকে গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক দ্বারা চোখের পর্দা কাটায়। আর হাতুড়ে চিকিৎসক পর্দা কাটার নামে ঘোলাটে লেন্সকে ধাক্কা দিয়ে চোখের পিছনের দিকে ফেলে দেয়।
চোখের ছানির কারণ:
১. চোখের ছানির সঠিক কারণ অজানা। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ রোগ হতে দেখা যায়। আবার মা- বাবার ছানি থাকলে ছেলে মেয়েরও সম্ভাবনা থাকে। তবে মা-বাবার যদি বেশি বয়সে অর্থাৎ ৬০-৬৫ বছর বয়সে ছানি হয়, তাহলে ছেলেমেয়ের আরও কম বয়সে অর্থাৎ ৪৫-৫০ বছর বয়সে ছানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাঁরা দু’ভাবে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
(ক) রোগীর দেহে সুগারের পরিমাণ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেলে চোখের পরকলার (lens) জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে অনেক দিন ধরে রক্তে সুগারের মাত্রা ২০০ মি. গ্রা. বা ততোধিক হলে ‘সেরবিটালা’ নামক এলকোহলের আধিক্য দেখা দেয়। যার উপস্থিত পরকলার জন্যে ক্ষতিকর। ফলে পরকলা অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। এ প্রকার ছানি কম বয়সের ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
(খ) দ্বিতীয় প্রকারের ছানি ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি হতে দেখা যায়।
২. ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ই’ এ দুটি অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাবে চোখে ছানি পড়ার আশংকা থাকে। যাদের শরীরে ভিটামিন ‘ই’ এবং ‘ক্যারোটিন’র অভাব আছে, তাদের পরবর্তীকালে চোখে ছানি পড়ার আশংকা তিনগুণ বেড়ে যায়। গবেষকরা মনে করেন, ‘যে সব রাসায়নিক পদার্থ চোখের (প্রোটিন) উপাদানগুলোকে অক্সিজেনযুক্ত করে, সেগুলোর কারণে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির সাথে চোখের ছানির সম্পর্ক আছে। এ ক্ষয়ক্ষতির প্রতিহত করার ক্ষমতা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যায়। ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ই’ এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং এগুলো ঐ ক্ষতি রোধে সহায়তা করে।
৩. অধিক উত্তাপ বা রোদে ঘোরা, রোদে বসে কাজ করা, ইত্যাদি কারণেও ছানি পড়তে পারে।
৪. সিফিলিস রোগের কারণেও চোখে ছানি পড়তে পারে।
৫. জন্মের সময় শিশু চোখে ছানি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। এটাকে Congenital Cataract বলা হয়। এ ধরনের ছানির হার খুব কম।
৬. অনেক সময় চোখে আঘাতজনিত ছানি সৃষ্টি হতে পারে। এটাকে বলা হয় Traumatic Cataract। আমাদের দেশে এ ধরনের চোখের ছানির হার কিছুটা বেশি।
চোখের ছানির লক্ষণ:
আস্তে আস্তে দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। চোখের লেন্স ও আবরণী পর্দা দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে দূরের কোনো পদার্থ পরিষ্কারভাবে দেখে না। উজ্জ্বল আলো দেখে দূরের প্রদীপের আলো বলে ভুল করা। আবার অনেক সময় একটি আলোকে অনেকগুলো আলো বলে মনে করে। চোখের সামনে বিভিন্ন রংয়ের আলোর উপস্থিতি। চোখের স্বাভাবিক বর্ণ ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে।
ছানির চিকিৎসার পরামর্শ:
চোখের ছানির প্রাথমিক অবস্থায় হোমিওপ্যাথি ওষুধ অত্যন্ত কার্যকর। এতে অপারেশনের কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যখন চোখের পুতলী এবং শ্বেতাংশ ক্রমে ক্রমে শক্ত হয়, তখন সাধারণত অপারেশন ছাড়া আরোগ্য হয় না। প্রধানত দু’প্রকার অপারেশন প্রচলিত আছে। যেমন:
১. Intracapsular cataract extraction এবং
২. Extracapsular cataract extraction।
চোখের ছানির যে কোনো অবস্থায় এবং যে কোনো বয়সে অপারেশন করা যায়। ডায়াবেটিস কিংবা হৃদরোগ থাকলে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অবশ্য বর্তমানে ডায়াবেটিস থাকলেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করে অপারেশন করা যায়।
প্রফেসর পি. মণ্ডল বলেন, ‘বেশি বয়স হলে অনেকেই অপারেশন করাতে চান না। অথবা বয়স হয়ে গেছে একটা চোখে ছানি অপারেশন হয়েছে এমন ব্যক্তিরা প্রায়ই বলেন, একটা চোখে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি আর অপারেশনের ঝামেলার দরকার নেই। এটা খুব বিপজ্জনক ভাবনা।
ছানি থেকে যাওয়ার পরও কেউ যদি ছানি কাটাতে গড়িমসি করেন, তাহলে তাঁর ছানি থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে গ্লুকোমা হতে পারে কিংবা শেষ পর্যায় গ্লুকোমা বেড়ে যেতে পারে এবং শেষ পর্যায়ের এ গ্লুকোমাকে বলা হয় Phacolytic Glaucoma। চোখ লাল হয়ে অস্বস্তি হতে পারে, শেষকালে এমন হতে পারে যে, চোখটা হয়তো তুলে ফেলতে হবে। তাই সঠিক সময়ে সুচিকিৎসা করা না হলে অন্ধত্বের হার বৃদ্ধি পাবে। [ইশরাত জাহান মিম]
সহায়িকা: ড. এম. এ. মান্নান কবীর, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও ইসলাম (২০১৮), সম্পাদনায়: মোহাম্মদ লুৎফর রহমান সরকার, প্রকাশক: ড. সৈয়দ শাহ্ এমরান, ঢাকা – ১২০৭, পৃষ্ঠা ৫০ – ৫২।
Image Source: wikipedia.org