জন্ডিস: লক্ষণ, ধরন, কারণ ও প্রতিকার
জন্ডিস শব্দের অর্থ হলুদ। তাই এই রোগ হলে চোখ হলুদ, ও চামড়ার বর্ণ হলুদ হয়ে যায় এবং সে জন্যই এই রোগটির নাম হলো জন্ডিস। এই রোগ হলে রক্তের রক্ত-কণিকা ভেঙে বিলিরুবিন (Bilirubin) রক্তে বেশী জমা হয়ে পড়ে, যার জন্য শরীরের রং অনেকটা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা 1.0 mg এর নিচে, যখন মাত্রা 2-3 mg এর বেশি হয়, সাধারণত জন্ডিস হয়।
জন্ডিসের লক্ষণ: জন্ডিসের কিছু লক্ষণ আছে, যা ভালোভাবে লক্ষ করলে প্রথম থেকেই এই রোগ নির্ণয় করা সহজ হয় এবং তখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করলে অনেকটা সহজে এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
১. প্রথমেই ৩-৪ দিন সামান্য সামান্য জ্বর হয়। সাধারণত (১০০ থেকে ১০১ ডিগ্রী সে.);
২. কাজে তার খুব একটা উৎসাহ বোধ হয় না;
৩. ক্ষুধা কমে যায় এবং সে তার খাওয়ার প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলে, ভালো ভালো মুখরোচক খাদ্যও তার ভালো লাগে না, জোর করে খেলেও তা হজম হয় না;
৪. পেট ফুলে থাকে;
৫. বিলরুবিন-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পওয়া;
৬. নাড়ির গতি (Pulse rate) কমে যাওয়া (৭০-৭২ থেকে ৫০-৬০ এ নেমে আসে,স্বাভাবিক Pulse rate হলো ৬০-১০০;
৭. লিভারের আকার বৃদ্ধি পায়; এবং
৮. শরীরে কিছুটা চুলকানি হয়ে থাকে।
এবং লিভার-সেলের অসুস্থতার কারণেই হজমের ব্যাঘাত ঘটে এবং তার জন্যই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিছুদিন এই অবস্থা চলার পরই চোখ ও শরীরের রং হলুদ হয়ে। শরীরের রং হলুদ হওয়ার আগেই যে জিনিসটি দেখে এই রোগ চেনা যায়, সেটা রোগীর প্রস্রাব ভাল করে লক্ষ করলে রোগী দেখতে পারে যে, তার ক্ষুধা-মন্দ্য হওয়ার পরই প্রস্রাবের রং হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে, এবং তখনি প্রস্রাবের একটা বিশেষ পরীক্ষা করলে, যাকে বলে বাইল পিগমেন্ট টেস্ট (bile pigment test)। এই রোগ ধরা পড়লে প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা সম্ভব হবে। উপরিউক্ত লক্ষণ দেখে জন্ডিসের কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
জণ্ডিসের ধরন: মানবদেহে তিন ধরনের জণ্ডিস হতে পারে। যেমন:-
(১) টক্সিক (Toxic) বা হেমোলাইটিক (Haemolytic) টাইপ,
(২) ইনফেকটিভ (Infective) টাইপ,
(৩) অবসট্রাকটিভ (Obstructive) টাইপ।
১. টক্সিক বা হেমোলাইটিক টাইপ: এটি কোন বিষাক্ত পদার্থ বা ওষুধ দ্বারা রক্তের রক্ত-কণিকাগুলি ভেঙে যায়, বিলিরুবিন বের হয়ে আসে এবং জন্ডিসের সৃষ্টি করে। ওষুধের মধ্যে আর্সেনিক (arsenic) এবং ক্লোরোফর্ম (chloroform) জাতীয় ওষুধ সেবনে এ ধরনের রোগ হতে পারে, সাপের কামড় (snake bite) থেকেও এ ধরনের রোগ হতে পারে। (সাপের বিষ দুই রকম: একটা হলো নিউরোজেনিক (neurogenic), যা দ্বারা শরীরের নার্ভগুলো অবশ হয়ে যায়, আর অন্যটি হেমোলাইটিক (Heamolytic), যা দ্বারা রক্ত-কণিকাগুলি ভেঙে যায়।
তাছাড়া জন্ডিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো: আজকাল সবচেয়ে বেশী জন্ডিস হয় ভেজাল খাদ্য খেয়ে। সবচেয়ে বেশি ভেজাল মেশানো হচ্ছে ঘি ও তেলজাতীয় খাদ্যে। আজকাল শহরবাসীদের প্রধান ভোজ্যতেল হলো সয়াবিন। আর এই সয়াবিনেও নানাবিধ ভেজাল মেশানো হয়। যা খেয়ে পেটের নানা প্রকার পীড়া দেখা দেয়।
২. ইনফেকটিভ টাইপ (Infective Jaundice): এ জন্ডিস বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাস (virus), ব্যাকটেরিয়ার (bacteria) দ্বারা হয়ে থাকে এবং রোগ-জীবাণু দ্বারা লিভার-সেল আক্রান্ত হওয়ায় এই রোগের সৃষ্টি হয়।
ভাইরাস দ্বারা লিভারের এক রকম রোগ হয়, যাকে বলে ইনফেকটিভ হেপাটাইটিস (infective hepatitis) এবং এটাই হলো জন্ডিস রোগের প্রধান কারণ। অন্য আরও একটি রোগ দ্বারা জন্ডিস হতে পারে, সেটা হলো অ্যামিবিক হেপাটাইটিস (amoebic hepatitis)। আমাদের দেশে আমাশয়ের প্রকোপ অত্যন্ত বেশী এবং এই আমাশয় রোগে দীর্ঘদিন ভুগতে থাকলে তাতে লিভার আক্রান্ত হয় এবং জন্ডিস সৃষ্টি করে।
এছাড়া অন্যভাবেও এই রোগ বিস্তার লাভ হতে পারে। যেমন- ইন্জেকশনের সিরিঞ্জ দ্বারা হাসপাতালে একই সিরিঞ্জ দ্বারা বিভিন্ন রোগীকে ইনজেকশন দেয়া হয়। ফলে একজন থেকে অন্যজনে ভাইরাস দ্বারা রোগ ছড়ায়। এবং রক্তগ্রহণ বা Blood transfusion দ্বারা। যিনি রক্ত দান করেন, তার রক্তেও রোগ-জীবাণু থাকতে পারে, যা দ্বারা রক্তগ্রহীতা এই দুই জনের রক্তের গড়মিল থাকতে পারে। যদি তা থাকে, তাহলে রক্ত-গ্রহীতার রক্ত-কণিকাগুলি সাংঘাতিকভাবে ভেঙে যাবে এবং ফলে ভয়ানক জন্ডিস দেখা দেবে। এই জন্যই রক্ত-গ্রহণের আগে উভয়ের রক্তের গ্রুপ ভালো করে পরীক্ষা করে নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
৩. অক্সট্রাক্টিভ টাইপ: কোনো বাধার কারণে লিভার সেল থেকে বিলিরুবিন বাইল-ডাক্ট (bile duct) (bile হলো পিত্তথলিতে থাকা হলদেভাব সবুজ তরলকে বুঝায়া) দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে না। এই বাধার কারণগুলি হলো-Gall bladder বা পিত্ত-থলিতে পাথর হওয়া, লিভার, পাকস্থলি বা প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার হওয়া, হাইডোটিড সিস্ট (hydatid cyst) বলে এক রকম সিস্ট হওয়া, দীর্ঘদিন সিফিলিস্ রোগে ভুগতে ভুগতে লিভারে গামা হওয়া (gumma of the liver), অথবা হজকিন ডিজিজ (hodge kin’s disease) থেকে লিম্ফ গ্লান্ড (Lymph gland) বড় হয়ে যাওয়া।
জন্ডিসের প্রতিকার: এ রোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে হবে এবং দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তবে জন্ডিসের হাত থেকে বাঁচার জন্য সর্ব সাধারণ যা করতে হবে, তা হলো :-
১. ভেজাল খাদ্য পরিত্যাগ করা। মোটকথা ভেজালের প্রতি এবং ভেজালকারীদের প্রতি একটা দারুণ অনীহা, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা জন্মাতে হবে।
২. চর্বি-জাতীয় খাদ্য যেমন; (ঘি, তেল, মাখন, ছানা, তেলওয়ালা মাছ ও মাংস) একদম বর্জন করতে হবে।
৩. শর্করা ও আমিষজাতীয় খাদ্য বেশী করে খেতে হবে। শর্করাজাতীয় খাদ্য হলো: ভাত, রুটি, আলু, ইত্যাদি। আর আমিষজাতীয় খাদ্য হলো: মাছ, মাংস, ডিম ও মুসুর ডাল। জন্ডিস রোগীর সবচেয়ে বড় পথ্য হলো: গ্লুকোজ ও আখ। আখের রস যত বেশী খাওয়া যাবে, ততই উপকার। আখ না পাওয়া গেলে, ফার্মেসী থেকে প্যাকেটের গ্লুকোজ কিনে খেতে হবে। একান্ত প্রয়োজনে রোগীকে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে। এর সাথে যে ওষুধ খাওয়া যায়, তা হলো ভিটামিন ‘সি’ এবং ভিটামিন ‘কে’। ভিটামিন ‘কে’ ইনজেকশন ও ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায় কিন্তু এটার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া ভাল।
তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই নির্দ্বিধায় যেটা খাওয়া যায় এবং জন্ডিসের জন্য যেটা অত্যন্ত উপকারী, সেটা হলো: ভিটামিন (C)। লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙা, আমরা, আনারস, লিচুতে প্রচুর ভিটামিন পাওয়া যায় যায়। ভিটামিন C-কে বলা হয় (cementing substance of the body), কেননা ভিটামিন C শরীরের সেলগুলোকে জোড়া দিয়ে রাখে এবং সেল-এর মাঝখানের ফাঁকগুলিকে বন্ধ করে দেয়, ফলে রোগ-জীবাণু সহজে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে ভিটামিন ‘C’ রোগ প্রতিরোধ করে, যার জন্য সর্দি, কাশী, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি রোগে মানুষ বেশী করে আনারস, আমড়া, কামরাঙা ও লেবু খেয়ে থাকে। ভিটামিন C রক্ত উৎপাদনেও সাহায্য করে, আবার রক্ত-কণিকাগুলি যাতে সহজে ভেঙে না যায় সে ব্যাপারেও সাহায্য করে, তাই জন্ডিস রোগে ভিটামিন C অত্যন্ত উপকারী। [ইশরাত জাহান মিম]
সহায়িকা: ড. (ক্যাপ্টেন) আবদুল বাছেত, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ইসলাম (২০০৫), মোহাম্মদ লুৎফর রহমান সরকার সম্পাদিত, প্রকাশক: ড. সৈয়দ শাহ্ এমরান, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭, পৃষ্ঠা ১৩৮ – ১৪২।
জন্ডিসের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার।
Follow Us in Our YouTube channel: GEONATCUL