ডায়াবেটিস কি এবং কেন হয়?

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্ররোগ শব্দটি আমাদের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী নেই। ডায়াবেটিস একটি বিপজ্জনক রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ। এ রোগের অত্যাধিক বিস্তারের কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাম্প্রতিককালে এমন ঘোষণা দিয়েছে।

ডায়াবেটিস কি?
যখন কারও ডায়াবেটিস হয়, তখন ঐ মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে দেহের কোষে গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না। এতে করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। যখন প্রস্রাব বেশি হয়, তখন ডায়াবেটিসে রোগী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন।

ডায়াবেটিস (যা ডায়াবেটিস মেলাইটাস নামেও চিকিৎসকদের কাছে পরিচিত) হলো একটি গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদি অবস্থা, যখন রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। কারণ- মানবদেহ যথেষ্ট পরিমাণে কিংবা কোনো ইনসুলিনই উৎপাদন করতে পারে না কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে দেহে ব্যবহার করতে পারে না।

ডায়াবেটিস সাধারণত দু’প্রকার:
১. ডায়াবেটিস মেলিটাস; এবং
২. ডায়াবেটিস ইনসেপিডাস।
ডায়াবেটিস আছে কিনা, তা পরীক্ষা করার জন্য প্রাথমিকভাবে জমানো প্রস্রাবে কালো পিঁপড়া এলে প্রস্রাব পরীক্ষা করানো দরকার। কোনো সুগার বা ডায়াবেটিস (বহুমূত্র) রোগের নিদর্শন আছে কি না, তা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়।

→ ডায়াবেটিস-এর কারণ:

সাধারণত অগ্নাশয় (pancreas) নামক আমাদের পেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্গান (organ) অর্থাৎ বিপাকীয় অন্ত্রের অসুস্থতা, অকার্যকারিতা, কার্যসম্পাদনে ব্যর্থতা, অন্য রোগের কারণে শৈল্য চিকিৎসার ফলে এ অন্ত্রের ক্ষতি বা ধ্বংস, ইত্যাদি কারণে আমাদের বিপাকীয় কাজের অপরিহার্য বিপাকীয় বা হজমী রস ‘ইনসুলীন’, যা এ অগ্নাশয় কর্তৃক প্রস্তুত হয়, তার অভাব ঘটলেই বহুমূত্র অর্থাৎ মধুমেহ রোগ হয়। যে কোনো বয়সে, যে কোনো সময়ে এবং যে কোনো লোক ডায়াবেটিস-এর শিকার হতে পারে। তবে তিন শ্রেণীর লোকের মধ্যে এর প্রবণতা অত্যাধিক। যেমন-

ক. যাদের বংশের বা রক্তের সম্বন্ধের মধ্যে ডায়াবেটিস আছে, তাদের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে;

খ. মাত্রাতিরিক্ত ওজন ও মেদবহুল দেহধারী মানুষ;

গ. শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের অভাব। বিশেষ P জাতীয় লোক। যেমন: P-পুলিশ, P-প্রফেসর বা অধ্যাপক, P-পলিটিশিয়ান বা রাজনীতিবিদ, P- Physician বা চিকিৎসক, P-Pupils-রাতজাগা পড়ুয়া শিক্ষার্থী, প্রমুখের বেশি হয়।

→ ডায়াবেটিস সৃষ্টির পরিবেশ:

১. শারীরিক স্থূলতা;
২. গর্ভাবস্থা;
৩. আঘাত;
৪. ক্ষত;
৫. অস্ত্রোপচার;
৬. মানসিক বৈকল্য;
৭. দুশ্চিন্তা, হতাশা;
৮ মানসিক বিপর্যয় বা আঘাত; ও
৯. চল্লিশ বা চল্লিশোর্ধ্ব বয়স।

→ ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ: এখানে আছে ৭টি (P) –
১. Polyurea – ঘন ঘন প্রস্রাব;
২. Polydypsia – ঘন ঘন পিপাসা;
৩. Polyphagia – ঘন ঘন ক্ষিধে;
৪. Physical Weight Loss – যথেষ্ট ভুঁড়ি ভোজন সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া, চামড়া শুকিয়ে যাওয়া;
৫. Physical Feebleness and Tiredness – শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি;
৬. Peripheral Scabies – খোস-পাঁচড়া, প্রভৃতি চর্মরোগ;
৭. Peripheral Neuropathy – হাত-পা অবশ ও অনুভূতিহীনতা ও Eye Sight Loss – চোখে রক্ত বা ছানিজনিত দৃষ্টিশক্তিহীনতা।

ডায়াবেটিস কি এবং কেন হয়?

→ ডায়বেটিস প্রতিরোধ, প্রতিবিধান, ও প্রতিকার:

ডায়াবেটিস একবার হলে সারানো কঠিন। সম্পূর্ণ সারানো যায় না; কিন্তু এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং এটাই ডায়াবেটিস চিকিৎসার মুখ্য উদ্দেশ্য। এ রোগের প্রতিরোধের জন্য ৪টা ডি (DDDD) অবশ্যই মানতে হবে। এতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত এবং দীর্ঘায়ু লাভ সহজ হবে।

1. D-Diet Control – খাদ্য নিয়ন্ত্রণ,
2. D-Drugs – ওষুধ,
3. D-Discipline – শৃঙ্খলা,
4. D-Daily Exercise and Walking – দৈনিক ব্যায়াম ও হাঁটা। উপরোক্ত চারটি ‘D’ না মানলে ডায়াবেটিস রোগীর গুরুতর পরিণতি অবধারিত।

→ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ:

যেহেতু রক্তে প্রয়োজনাতিরিক্ত ও অপরিপাককৃত শর্করা; অর্থাৎ চিনি বৃদ্ধি তথা অসম খাদ্যই ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ, শর্করাযুক্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রণই ডায়াবেটিসের প্রধান উপায়।

ডায়াবেটিস রোগীকে সুষম খাদ্য নিয়মিত ও সময়মত খেতে হবে। মিষ্টি জাতীয় খাদ্য, যেমন – চিনি, গুড়, খেজুরের রস, যে ফল পাকলে মিষ্টি হয় – কাঁঠাল, পাকা পেঁপে, পাকা কলা, পাকা আম, মিষ্টি, ইত্যাদি বাদ দিতে হবে। একজন পূর্ণবয়স্ক কর্মব্যস্ত লোকের জন্য ২০০ ক্যালরী সমৃদ্ধ শর্করা ৭১.৫ গ্রাম, আমিষ ৭৪.০ গ্রাম, চর্বি- ৬৫.৮ গ্রাম। তবে মিশ্রি, চিনি, গুড় জাতীয় শর্করা সম্পূর্ণ বর্জনীয়। যে কোনো কারণে যদি কোনো মিষ্টি বা মিষ্টি ফল খাওয়া পড়ে, ঐ মিষ্টি বা ফলে যে পরিমাণ শর্করা আছে, সে পরিমাণ শর্করা সম্বলিত অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সে দিনের জন্যে খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। শস্য জাতীয় খাদ্য ও মাটির নিচের শাঁস ও মূলজাতীয় তরকারী না খাওয়া ভালো। উচ্ছে, কাঁচা রসুন, ও প্রচুর পানি পান করা ফলদায়ক।

ডায়াবেটিস রোগীকে অত্যন্ত সময় ও নিয়মানুগভাবে চলতে হবে। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকে। শৃঙ্খলার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো প্রধান:

১. নিয়মিত সুষম খাদ্য খেতে হবে;

২. নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে;

৩. ওষুধ ও চিকিৎসা যদি প্রয়োজন হয়, তা নিয়ম মত চালিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্রাদি যদি থাকে, তা পালন করতে হবে;

৪. শরীর, জামা-কাপড়, বিছানাপত্র ও ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে;

৫. পায়ের যত্ন নিতে হবে।

৬. নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা – দৈনিক অন্তত দু’বার ভোরে খালি পেটের প্রথম প্রস্রাব এবং দুপুরে খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর করতে হবে। প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফল সংরক্ষণ করার জন্য একটি ভালো খাতা তৈরী করে তাতে ফলাফল নিয়মিত লিখে রাখতে হবে।

৭. মিষ্টি সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে।

৮ শারীরিক যে কোনো অবনতি বা অসুবিধার কারণে সুচিকিৎসকের পরামর্শ বা নিকটস্থ ডায়াবেটিক সেন্টারে দেখা করতে হবে।

৯. একমাত্র ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসা না করা। মনে রাখতে হবে যে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ব্যায়াম ও শরীর (exercise and walking) এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১০. ডায়বেটিস রোগীদের খুব সতর্কতার সাথে চলাফেরা করতে হবে। কেননা যদি রোগীর শরীরে কোনো ক্ষত বা ঘা এর সৃষ্টি হলে, তা সহজে ভালো হয় না এবং দেখা যায় সেই ছোট্ট ক্ষত একসময় বড় সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং ডায়বেটিস মাত্রাতিরিক্ত থাকার ফলে ক্ষতে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, তখন দেখা যায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ইনফেকশন হওয়া অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়, ফলে ভয়ানক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। তাই ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

চিকিৎসা :
ডায়বেটিস বা রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়াকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া (রক্তে উচ্চ শর্করা) বলে। এবং সুগার কমে  যাওয়াকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। সুগার কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) সৃষ্টি হলে, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা, ঝাপসা দৃষ্টি, জিহ্বা, ঠোঁট বা গালে অসাড়তার সৃষ্টি হয়।

আর যদি হাইপারগ্লাইসেমিয়া (উচ্চ শর্করা) সৃষ্টি হয় তাহলে – ঘন প্রস্রাব হবে, তরল পান করার পরেও তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়, ওজন হ্রাস, শুষ্ক মুখ বা মুখ ও গলায় অস্বস্তি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলেও ক্লান্তি, ক্ষত ধীরে ধীরে নিরাময় হওয়া, আবৃত্তিশীল সংক্রমণ সৃষ্টি হওয়া, কাজের উপর মনোযোগ দিতে অসুবিধা।

উপরিউক্ত জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এ ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ ও প্রস্রাব পরীক্ষা করে শৃঙ্খলা নিয়মিতভাবে মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত সুগার টেস্ট করা জরুরি, ডায়াবেটিস খালি পেটে ৬ – ৭ এবং ভরা পেটে ৭ – ৮ স্বাভাবিক।

খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সকল ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তাতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না এলে কাল বিলম্ব না করে রক্তে শর্করার আধিক্য অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ মত ঔষধ বা ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিতেই হবে। [ইশরাত জাহান মিম]


সহায়িকা: ১. ড. আলহাজ্জ ম. মনিরুল আলম, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও ইসলাম (২০০৫), মোহাম্মদ লুৎফর রহমান সরকার সম্পাদিত, প্রকাশক: ড. সৈয়দ শাহ্ এমরান, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭, পৃ: ৬১-৬৩;

২. সুলতানা, প্রফেসর রাফিকা, এবং আরা, গাজী হোসনে, গার্হস্থ বিজ্ঞান, কাজল ব্রাদার্স লি., ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩১৫।


ডায়াবেটিস এর লক্ষণ কি?


Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL


Leave a Reply