ডেঙ্গু জ্বর | Dengue Fever

ডেঙ্গু জ্বরের সাথে আমরা সকলেই মোটামুটি পরিচিত। ডেঙ্গু জ্বর এডিস ইজিপ্টি (Aedes Aegypti) নামক মশার কামড়ের কারণে হয়ে থাকে। এডিস ইজিপ্টি (Aedes Aegypti) মশা ছোট, গাঢ়ো বর্ণের হয় এবং যার শরীরে ও পায়ে সাদা ডোরাকাটা দাগ থাকে। এ মশা মানুষের আবাসস্থল এবং তার আশেপাশে বংশবিস্তার করে। একটি মশা যখন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দেয়, তখন ভাইরাসটি মশার মধ্যে প্রবেশ করে। সংক্রমিত মশা যখন অন্য ব্যক্তিকে কামড় দেয়, তখন ভাইরাসটি সেই ব্যক্তির রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে। এডিস মশা সব সময়ই কামড়াতে পারে, তবে সূর্যোদয়ের পরে প্রায় দুই ঘন্টা,  সূর্যোস্তের দুই/তিন ঘন্টা আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, এবং রাতের উজ্জ্বল আলোতে কামড়ানোর সম্ভবনা থাকে। এরা ঘরের কোনায় বা অন্ধকার স্থানে, শীতল ছায়াময় স্থানে বসবাস করতে পছন্দ করে। এবং এডিস এজিপ্টি প্রজাতির মশা মানুষকেই কামড়াতে পছন্দ করে বা কামড়ায়। মশার এ আচরণকে বলা হয় এনথ্রোপোফিলিক আচরণ। বাতাসে তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের নিচে চলে গেলে এডিস মশা কামড়ানোর মাত্রা অনেক।

a mosquito on a skin, এডিস মশা, ডেঙ্গু জ্বর
এডিস মশা

ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর (Dengue hemorrhagic fever): ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের তিনটি ধাপ রয়েছে:
১। সাধারণ জ্বর (Febrile): এ অবস্থায় তীব্র জ্বর ( > ৪০° সে.) সাথে তীব্র মাথা ব্যথা ও শরীরে ব্যথা থাকে। মাথা গুরানো, বমি বমি ভাবও থাকতে পারে, এ জ্বর ২ – ৭ দিন স্থায়ী হয়।

2। সংকটপূর্ণ অবস্থা (Critical): ডেঙ্গু রোগের সংকটপূর্ণ অবস্থা ৩ – ৪ দিন পর দেখা যায়। এ অবস্থায় শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালী থেকে প্লাজমা বা ফ্লুইড বের হয়ে আসে। শরীরের ভিতরে ও বাহিরে বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষরণ হয় এবং শরীরের ভিতরে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া (Coagulation System) সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে রোগীর রক্তচাপ কম থাকে এবং এক পর্যায়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় বা শক সিন্ড্রোমে (কোমায় চলে যাওয়ার মতো) চলে যায়। সাধারণত প্লাজমা লিকেজ ৩৬ – ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত চলে। এ অবস্থায় রোগীকে শিরাপথে স্যালাইন, ও রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়। এবং একজন সুস্থ মানুষের শরীরে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ হয়ে থাকে, সেখানে ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেটের সংখ্যা এক লাখের নিচে নেমে আসে।

৩। আরোগ্য লাভ পর্যায় (Recovery): সংকটপূর্ণ অবস্থা যদি পার করা যায়, তাহলে ৬ – ৭ দিন পর রোগের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। এ সময় রক্তনালি থেকে যে প্লাজমা বা ফ্লুইড ক্ষয় হয়েছিল, তা পুনরায় রক্তনালীতে ফিরে যায়।

a man's back with no shirt, ডেঙ্গু জ্বরের সময় শরীরে দেখা যাওয়া ফুসকুড়ি, ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু জ্বরের সময় শরীরে দেখা যাওয়া ফুসকুড়ি

ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে উঠতে যে সকল খাবার উপকারীঃ

• ডেঙ্গু জ্বরজনিত রোগীদের শরীরকে পানি শূন্যতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হয়। তরল পান করার মাধ্যমে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে দৈনিক গড়ে ২ – ২.৫ লিটার পানি বা তরল গ্রহণ করা উচিত। ডেঙ্গু জ্বরের মূল চিকিৎসা হচ্ছে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা প্রতিরোধ।

ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর অরুচি দেখা দেয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। উচ্চমাত্রায় জ্বর এবং বমি শরীরকে পানি শূন্য করতে পারে, শরীর থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ পদার্থসমূহ বের হয়ে যায়। দেহে পানিশূন্যতা ও খনিজ লবণের তারতম্য দেখা যায়, ফলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। রক্তনালীর ভিতরে তরলের ভারসাম্যহীনতা জটিলতার অন্যতম কারণ। ডেঙ্গু জটিলতা কমাতে চিকিৎসকগণ তাই বিশ্রাম, পথ্য ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণের জন্য জোর দিয়ে থাকেন। ডেঙ্গুতে শরীরে খনিজ লবণের তারতম্য ঘটে বলে ডাবের পানি, স্যালাইন পানি, ফলের রস, লেবুপানির শরবত, ইত্যাদি পান করা উচিত। ডায়াবেটিস থাকলে চিনিহীন তরল যেমন- ডাবের পানি, ফলের রস, ইত্যাদি। কিডনি রোগীদের জন্য আবার ডাবের পানি পান করতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, কারণ পটাশিয়াম বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।

• যখন রোগী সাধারণ শক্ত খাবার খেতে পারে না, তখন তাজা ফল যেমন: কলা, আপেল, ডালিম, সাইট্রাস, পেয়ারা এবং অন্যান্য খাবার দিয়ে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া যায়, কারণ এ সকল খাবার খনিজ এবং ভিটামিনের অভাব পূরণ করতে সহায়তা করে। শক্ত খাবার খেতে গেলে অনেক সময় রোগীর মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। তাই শক্ত ও মুচমুচে খাবার বেশি না খাওয়াই ভালো। যে সকল খাবারে জলীয় অংশ বেশি যেমন- স্যুপ, ডাল, পাতলা ঝোলের তরকারি, লাউ বা চালকুমড়ার ঝোল, ইত্যাদি খাবার গ্রহণ করা উচিত। বার্লি (সাতু) লিভারকে ডিটক্সাইফাই বা যকৃতের ক্ষতিকর উপাদানসমূহ দূর করতে সহায়তা করে।

পেঁপেঃ যারা ডেঙ্গুতে ভুগছেন তাদের জন্য পেঁপে পাতা ও এর রস বেশ ভালো উপকারী।

ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ খাবারঃ ভিটামিন-কে রক্তের প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা এর পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে। ডেঙ্গু রোগীদের ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাবার যেমন- ফুলকপি, ব্রকোলি, পাতাকপি, সবুজ শাকসবজি, ডিমের কুসুম, ইত্যাদি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

• আনার বা ডালিম বেশ পুষ্টিকর ফল এবং প্রচুর খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ, যা শরীরকে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।

বেশি বেশি ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ: ভিটামিন সি কোষের প্রতিরক্ষাকারী ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। মাল্টা, কমলা, আনারস, স্ট্রবেরি, পেয়ারা এবং কিউই লিম্ফোসাইটের (এক ধরণের প্রতিরক্ষাকারী কোষের) উৎপাদন বাড়ায়, যা ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এগুলো আপনার শরীরের অ্যান্টিবডিগুলি পুনরুদ্ধারেও সহায়তা করতে পারে। কিউই ফলে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই এবং পলিফেনল রয়েছে, যা কার্ডিওভাসকুলার বা হার্টের রোগে উপকারী হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে দেহে বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়, ক্যালরির চাহিদাও বাড়ে। পর্যাপ্ত ক্যালরি পেতে পুষ্টিকর খাবার, যেমন: চিকেন স্যুপ, ডিমের স্যুপ, ডালের স্যুপ, ইত্যাদি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেছে নিন।

• ডেঙ্গু রোগীরা ছাগলের দুধ পান করতে পারেন। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করে এবং রোগীকে হাইড্রেটেড রাখে।

• মাছ, মুরগী এবং টার্কির মতো চর্বিযুক্ত মাংসগুলিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, জিঙ্ক এবং ভিটামিন B-12 রয়েছে, এগুলি সমস্তই রক্তের প্লেটলেট পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে। শিমের মধ্যে ভিটামিন B-9, ফোলেট থাকে, যা রক্তের প্লেটলেট গণনাকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। B-9 সমৃদ্ধ অন্যান্য কিছু খাবার হলো পালংশাক, অ্যাস্পারাগাস এবং কমলা।

• নারকেল জল এবং ফল-মূল ও পানিশূন্যতা রোধে বেশ উপকারী।

• ডেঙ্গু জ্বরে অরুচির কারণে রোগী খেতে পারে না। তাই অল্প পরিমাণে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়, এমন খাবারের প্রতি জোর দিতে হবে। যেমন- চাল, ডাল ও সবজি দিয়ে তৈরী পাতলা খিচুড়ি, জাউ ভাত, মাছের বা মুরগীর পাতলা ঝোল, পায়েস, পুডিং, সুজি, দুধ, সাগু, ইত্যাদি। অর্ধতরল খাবার সহজে হজম হয়। ডেঙ্গুতে অনেকক্ষেত্রে লিভার এনজাইম বেড়ে যায়, অনেক সময় রোগী বমি করে, ডায়রিয়া হয়। তাই রোগীকে সহজপাচ্য হালকা তেল ও মসলাযুক্ত খাবার দেয়া প্রয়োজন।

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এমন খাবার হলোঃ ১। সাইট্রাসযুক্ত বা ভিটামিন সি যুক্ত ফল; ২। লাল মরিচ; ৩। ব্রকোলি; ৪। রসুন; ৫। আদা; ৬। পালং শাক; ৭। টক দই; ও ৮। অ্যামন্ড।

শরীরে রেড সেল বা লোহিত কণিকার পরিমাণ বাড়ায় এমন খাদ্য হলোঃ ১। গরুর মাংস এবং যে কোনো লাল মাংস; ২। কিডনি, লিভার ইত্যাদি মাংস; ৩। ঘন সবুজ শাক-সবজি; ৪। শীমের বীচ; ৫। লিগিউমস; ও ৬। ডিমের কুসুম।

৭। অন্যান্যঃ আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার (যেমন: ডিম, পুইশাক, শীম, চর্বিবিহীন মাংস, সামুদ্রিক মাছ) এবং ভিটামিন বি-৬, বি-১২, ফোলিক এসিডযুক্ত খাদ্যসমূহ (যেমন- মাছ, শাক সবজি, বাদাম, মটরশুটি, সিরিয়াল ইত্যাদি) শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।

ডেঙ্গু, সচেতনতাই সমাধান

প্লাটিলেট কমলে যা করণীয়:

রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে স্যালাইন দেয়ার পাশাপাশি ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, লেবুর শরবত- এসব প্রচুর পরিমাণে খাওয়াতে হবে, যাতে প্রেশার কমে রোগী শক সিনড্রোম পর্যন্ত না যায়। ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ তরল খাবার ঠিক মতো খেলে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই।

মেয়েদের ক্ষেত্রে সতর্কতাঃ

মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব বা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে পারে। যাদের ঋতুস্রাব হয়নি, তাদের ডেঙ্গু জটিলতার কারণেও মাসিকে রক্তপাত শুরু হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।

ডেঙ্গু জ্বরে গত কয়েক বছরে মৃত্যুর সংখ্যাও ব্যাপক ছিল। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে এর প্রাদুর্ভাব আছে। তাই ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু হলে হসপিটালে ভর্তিসহ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিনিৎসা নিতে হবে। [ইশরাত জাহান মিম]


সহায়িকা: আ.স.ম ওয়াহিদুজ্জামান, ডেঙ্গু সচেতনতাই সমাধান, সুখী ও সুস্থ গৃহ, স্বাস্থ পরিচর্যা সিরিজ-৪, হ্যাপি হোম এন্ড হেলথকেয়ার প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৩, ৮৬, ১৪৯ – ১৫৩।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Image Source: wikipedia.org


Leave a Reply