তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব

দুটি দেশের মধ্যে সংঘটিত বাণিজ্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদগণ যে তত্ত্ব প্রচার করেন তা তুলনামূলক খরচ বা ব্যয় তত্ত্ব নামে পরিচিত। কখনও কখনও এটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব নামেও অভিহিত করা হয়। মূলত ক্লাসিক্যাল তত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু শ্রম মূল্যের তথ্যের উন্নত রূপ হিসেবে অধ্যাপক ডেভিড রিকার্ডো তুলনামূলক ব্যয় তত্ত্ব বা তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্বটি ১৮১৭ সালে তাঁর ‘Principles of Political Economy’ গ্রন্থে উপস্থাপন করেন।

তুলনামূলক ব্যয় তত্ত্বের মূল বক্তব্য: দুটি দেশের দুটি দ্রব্য উৎপাদনের তুলনামূলক ব্যয় পার্থক্য। অর্থাৎ দুটি দেশের মধ্যে কোনো দেশ অন্য দেশের চেয়ে যে কোনো একটি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যয় সুবিধা ভোগ করলে দেশটি কেবল সে দ্রব্যটিই উৎপাদন ও রপ্তানি করবে, পাশাপাশি যে দ্রব্য উৎপাদনে তুলনামূলক সুবিধা কম, সে দ্রব্য স্বদেশে উৎপাদন না করে অপর দেশ হতে তুলনামূলক কম ব্যয়ে আমদানি করবে।
অনুমিত শর্তসমূহ: (১) শ্রম মূল্য; (২) পূর্ণ প্রতিযোগিতা; (৩) শূন্য পরিবহন খরচ; (৪) উপাদানের গতিশীলতা; (৫) সমজাতীয় শ্রম; (৬) স্থির ব্যয়; ও (৭) কেবল দুটি দেশ ও দুটি পণ্য।

তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব


তুলনামূলক ব্যয় পার্থক্য – এর উদাহরণ: উপরের তালিকায় তুলনামূলক ব্যয় পার্থক্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যয়ের অনুপাত হলো ১ : ১ কিন্তু ভারতে ব্যয়ানুপাত ১ : ১.৫। অনুপাত দুটি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, ১ মণ পাটের বিনিময়ে বাংলাদেশে পাওয়া যায় ১ মণ গম। কিন্তু ১ মণ পাটের বিনিময়ে ভারতে পাওয়া যায় ১.৫ মণ গম। সুতরাং বাংলাদেশ, ভারতে পাট রপ্তানি করে ভারত হতে গম আমদানি করলে লাভবান হবে। পক্ষান্তরে ১.৫ মণ গমের বিনিময়ে ভারতে পাওয়া যায় মাত্র ১ মণ পাট। কিন্তু বাংলাদেশে পাওয়া যায় ১ মণের অধিক পাট। সুতরাং ভারত, বাংলাদেশে গম রপ্তানি করে বাংলাদেশ হতে পাট আমদানি করলে লাভবান হবে। এভাবে দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। একটি চিত্রের সাহায্যে তুলনামূলক ব্যয় পার্থক্য ব্যাখ্যা করা হল:

তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব


ধরি I এবং II দুটি দেশ X এবং Y দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে। কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের বিনিময়ে II দেশ OB পরিমাণ X পণ্য বা OA পরিমাণ Y পণ্য উৎপাদন করতে পারে। পক্ষান্তরে একই শ্রমের সাহায্যে I দেশ পারে OD পরিমাণ X পণ্য বা OC’ পরিমাণ Y পণ্য উৎপাদন করতে পারে। চিত্রানুযায়ী উভয় পণ্যের উৎপাদনে II দেশের চরম ব্যয় সুবিধা রয়েছে। কারণ OB > OD এবং OA > OC’। চিত্রে CD’ রেখাকে AB রেখার সমান্তরাল করে আঁকা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে CD’ রেখার ঢাল হতে বুঝা যায় X পণ্য উৎপাদনে II দেশটির আপেক্ষিক সুবিধা বেশি।

কারণ Y পণ্য OC পরিমাণ প্রস্তুত না করে একই শ্রমের সাহায্যে তার পক্ষে OD’ পরিমাণ X পণ্য প্রস্তুত করা সম্ভব যা OD অপেক্ষা বেশি। পক্ষান্তরে যদি দেশটি OD পরিমাণ X পণ্য প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ত্যাগ করে, তবে তার পক্ষে OC এর চেয়ে কম পরিমাণ Y (OC’) প্রস্তুত করা সম্ভব। পক্ষান্তরে একই কারণে Y পণ্যে I দেশটির আপেক্ষিক সুবিধা রয়েছে। সুতরাং চিত্রানুযায়ী I দেশ Y পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করবে এবং II দেশ X পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করবে। এভাবে আপেক্ষিক বা তুলনামূলক ব্যয় সুবিধার কারণে দুটি দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংঘটিত হবে।

তুলনামূলক ব্যয় তত্ত্বটি সমালোচনা: রিকার্ডোর তুলনামূলক ব্যয় তত্ত্বটি প্রশংসিত হলেও আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ বিভিন্ন দিক থেকে তত্ত্বটির সমালোচনা করেছেন। নিচে তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্বটির সমালোচনাসমূহ তুলে ধরা হলো :

১. শ্রম ব্যয়ের অবাস্তব ধারণা: এই তত্ত্বে শ্রমের ব্যয় দ্বারা উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে শুধু শ্রমের মজুরি নয় বরং খাজনা, সুদ, মুনাফা অন্তর্ভুক্ত থাকে। ফলে শ্রম ব্যয় দ্বারা উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা অবাস্তব।

২. সমজাতীয় শ্রম: এই তত্ত্বে বিভিন্ন দেশে প্রতিটি শ্রমিকের দক্ষতা সমান ধরা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন দেশের সকল শ্রমিক সম দক্ষতা সম্পন্ন হয় না।

৩. স্থির উৎপাদন ব্যয়: তত্ত্বটি স্থির উৎপাদন ব্যয় ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু উৎপাদন ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান ও ক্রমবর্ধমান ব্যয় হতে পারে।

৪. উৎপাদনের উপাদানের গতিশীলতা: তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদনের উপাদানসমূহ পূর্ণ গতিশীল এবং বিভিন্ন দেশে সম্পূর্ণ গতিহীন ধরা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উপাদানসমূহ দেশের অভ্যন্তরে যেমন পূর্ণ গতিশীল হয় না, তেমনি দেশের বাহিরেও একেবারে গতিহীন নয়।

৫. পরিবহণ ব্যয় নেই: এই তত্ত্বে পরিবহণ ব্যয় উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে এই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কেননা পরিবহণ ব্যয় বাদ দিলে এক দেশ হতে অন্য দেশে পণ্যদ্রব্যের গতিশীলতা সম্পূর্ণরূপে বাঁধা পায়।

৬. অবাধ বাণিজ্য: অবাধ বাণিজ্য ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্বের ভিত্তি বাস্তবতার বিরোধী বর্তমানকালে পৃথিবীর কোনো দেশেই অবাধ বাণিজ্য পরিচালিত হয় না। অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বোধের কারণে সকল দেশই বাণিজ্যে সংরক্ষণ আরোপ করে।

৭. পূর্ণনিয়োগ: তত্ত্বটি পূর্ণনিয়োগ অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পূর্ণনিয়োগ অর্থনীতিতে বিরল।

৮. একমুখী তত্ত্ব: তুলনামূলক ব্যয় তত্ত্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যোগানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ফলে এখানে চাহিদার দিক উপেক্ষিত।

৯. কারিগরি জ্ঞানের ভূমিকা উপেক্ষিত: এই তত্ত্বে উৎপাদনে ব্যবহৃত কারিগরি জ্ঞান অপরিবর্তিত ধরা হয়েছে। ফলে এটা একটি গতিশীল তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। আধুনিক উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কারিগরি জ্ঞান নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং বিকাশমুখী।

১০. দুটি দেশ ও দুটি দ্রব্য মডেল: তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব দুটি দেশ ও দুটি দ্রব্য মডেলের উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু বাস্তবে একটি দেশ একই সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একাধিক দ্রব্য আদান-প্রদান করে থাকে।

সমালোচনা সত্ত্বেও তুলনামূলক ব্যয় তত্ত্বটি কালের বিচারে উত্তীর্ণ হয়েছে। তত্ত্বটি প্রকাশের পর প্রায় শতাব্দীকালব্যাপী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে তার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়, পরবর্তীকালে অর্থনীতিবিদগণ তা নানা সংশোধন ও উন্নতি সাধন করলেও মূল বিষয় একই থেকে যায়। [শারমিন জাহান সায়মা]


সহায়িকা: জোয়ারদার, সুকেশ চন্দ্র, আলম, মোঃ শাহ, ও আখতার, সুফিয়া, (২০২০), আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, মিলেনিয়াম পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৭১-৭২।


আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা তত্ত্ব


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply