থ্যালাসেমিয়া কী: এ রোগের কারণ, ধরন, লক্ষণ ও চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বংশবাহিত রক্তজনিত সমস্যা। থ্যালাসেমিয়া হলো রক্তের লোহিত রক্ত কণিকার এক অস্বাভাবিক অবস্থাজনিত রোগের নাম। এ রোগে লোহিত রক্ত কণিকাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রোগী রক্তশূণ্যতায় ভোগে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া’তে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার কারণে মানুষের অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। এই রোগ বংশপরম্পরায় হয়ে থাকে।
ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭০০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং বর্তমানে প্রায় এক লাখ রোগী রয়েছে। এটি একটি অটোসামাল রিসিসিভ ডিজঅর্ডার, অর্থাৎ বাবা ও মা উভয়ই এ রোগের বাহক বা রোগী হলে তবেই তা সন্তানের রোগ লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। চাচাতো – মামাতো – খালাতো ভাইবোন বা অনুরূপ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত সন্তান জন্ম দেয়ার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়ার কারণ: মানব দেঞের লোহিত রক্তকোষ দুই ধরনের প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এগুলো হলো A – গ্লোবিউলিন এবং B – গ্লোবিউলিন। লোহিত রক্তকোষে দু’টি প্রোটিনের জিন নষ্ট থাকার কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়, যার ফলে ত্রুটিপূর্ণ লোহিত রক্তকোষ উৎপাদিত হয়।
থ্যালাসেমিয়ার ধরন: দু’ধরনের জিনের সমস্যার জন্য দু’ধরনের থ্যালাসেমিয়া দেখা যায়। এগুলো হলো – আলফা (a) থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা (b) থ্যালাসেমিয়া। আলফা (a) থ্যালাসেমিয়া রোগ তখনই হয়, যখন যখন A গ্লোবিউলিন তৈরির জিন অনুপস্থিত থাকে কিংবা ত্রুটিপূর্ণ হয়। এই ধরনের রোগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও আফ্রিকা জনগণের মাঝে বেশি দেখা যায়। একইভাবে বিটা (b) থ্যালাসেমিয়া তখনই হয়, যখন B গ্লোবিউলিন প্রোটিন উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিটা থ্যালাসেমিয়াকে কুলির থ্যালাসেমিয়াও বলা হয়। এ ধরনের রোগ ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাবাসীদের মাঝে বেশি দেখা গেলেও কিছু পরিমাণ আফ্রিকা, আমেরিকা, চীন ও এশিয়াবাসীদের মধ্যেও দেখা যায়।

জিনের প্রাপ্তির উপর নির্ভর করেও থ্যালাসেমিয়াকে দু’ভাবে দেখা যায়, থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং থ্যালাসেমিয়া মাইনর। থ্যালাসেমিয়া মেজরের বেলায় শিশু তার বাবা ও মা দুজনের কাছ থেকেই থ্যালাসেমিয়া জিন পেয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়া মাইনরের বেলায় শিশু থ্যালাসেমিয়া জিন তার বাবা অথবা তার মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়া মাইনরের ক্ষেত্রে শিশুদের থ্যালাসেমিয়ার কোনো উপসর্গ দেখায় না। তবে থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহক হিসেবে কাজ করে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ: তীব্র থ্যালাসেমিয়ার কারণে জন্মের আগেই মায়ের পেটে শিশুর মৃত্যু হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া মেজর আক্রান্ত শিশুরা জন্মের পর প্রথম বছরই জটিল রোগে ভোগে। এছাড়া, থ্যালাসেমিয়া রোগের ফলে যকৃত নষ্ট হলে জন্ডিস, অগ্ন্যাশয় নষ্ট হলে ডায়াবেটিস, ইত্যাদি নানা প্রকার রোগ ও রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যদি এসব সমস্যা একবার শুরু হয়, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী ৩০ বছরের বেশি বেঁচে থাকার সম্ভবনা কম।

থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা: সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পর পর রক্ত প্রদান এবং নির্দিষ্ট ঔষধ খাইয়ে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা দেয়া হয়। রোগীদের লৌহসমৃদ্ধ ফল বা ঔষধ খেতে দেয়া হয় না, কারণ তা শরীরে জমে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতিসাধন করে। অতএব, আমাদের স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি এবং রোগ অনুযায়ী নির্দিষ্ট চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। [ইশরাত জাহান মিম]
সহায়িকা: জীববিজ্ঞান, বোর্ড বই (নবম-দশম), পৃষ্ঠা ২৬৮, ২৬৯, ২৭০।