বাংলাদেশের বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব

বিশ্বায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো পুঁজি, প্রযুক্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইত্যাদির বিশ্বব্যাপী অবাধ প্রবাহের মাধ্যমে পণ্যের ব্যাপক উৎপাদন, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদসহ সকল সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উন্নত, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য দূর করা। অধিক জনসংখ্যা, দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো, বিশেষায়নের অভাব, প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতার কারণে বিশেষায়নের সুযোগ বাংলাদেশ এখনও কাজে লাগাতে পারেনি। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিকগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

১. জনশক্তির সদ্ব্যবহার (proper utilization of manpower): বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এদেশে দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের পর্যাপ্ততা রয়েছে। শ্রমের প্রাচুর্যতার উপর ভিত্তি করে বিশ্বায়নের সুবাদে এ দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনেক শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছে। ফলে শ্রম শক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২. শ্রমের আন্তর্জাতিক গতিশীলতা সৃষ্টি (creation of international mobility of labour): বিশ্বায়নের কারণে বাংলাদেশের শ্রম বিশ্বব্যাপী গতিশীলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং অবহেলিত মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পাচ্ছে। এক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে জনশক্তি রপ্তানি খাতের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার (proper utilization of natural resources): বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। এদেশের উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ হলো: গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, ইত্যাদি। প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও পুঁজির অভাবে এসব সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বায়নের ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এসব সম্পদ উত্তোলন বা আহরণ করে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করবে। এতে দেশের অবহেলিত ও অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হবে।

৪. উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার (use of advanced technology): বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে তেমন উন্নত নয়। ফলে আধুনিক প্রযুক্তির তেমন কোনো বিকাশ ঘটেনি। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের প্রয়োগ না থাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিঘ্নিত হয়ে আসছিল, কার্যত বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশ অর্জন করেছে উন্নত দেশের আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। এসব প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ব্যবহার করে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডকে করা হচ্ছে গতিশীল।

৫. উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি (increasing efficiency of entrepreneurship): বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাগণ উন্নত দেশের উদ্যোক্তাগণের সাথে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে দেশীয় উদ্যোক্তার দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৬. জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ (expansion of knowledge and information technology): বিশ্বায়নের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হচ্ছে। ফলে ঘরে বসে কম্পিউটার, ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা সারা পৃথিবীর খোঁজ খবর নিতে পারি। এর ফলে আমাদের দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটছে।

৭. বাজার সম্প্রসারণ (extension of market): বিশ্বায়নের ফলে অবাধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে এদেশের পণ্য প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে রফতানি আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- পোশাক শিল্প।

৮. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন (development of international relationship): বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এদেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। সে সাথে বাংলাদেশ IMF, বিমসটেক, World bank, ইত্যাদি সংস্থার সক্রিয় সদস্য হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ উপর্যুক্ত এ সকল বিষয়ে বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলা সম্ভব হবে। [শারমিন জাহান সায়মা]


সহায়িকা: আখতার, সুফিয়া; শিরিন, প্রফেসর নাসিম ফারহানা; আহম্মদ, মোঃ জাফর; করিম, মোহাম্মদ নূরুল; সম্পাদনায়: এম. এ. কালাম; (২০১৯); আন্তর্জাতিক ব্যবসায়; ঢাকা: কমার্স পাবলিকেশন্স; পৃষ্ঠা ২৪-২৬।



Leave a Reply