বাণিজ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি
মার্কেন্টিলিস্ট (mercantilist) অর্থনীতিবিদগণ বাণিজ্য সংরক্ষণের পক্ষে কিছু মতামত প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে ক্লাসিকাল অর্থনীতিবিদগণের সময়ে অবাধ বাণিজ্য শুরু হয়। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আবার বাণিজ্য সংরক্ষণের পক্ষে মতামত গড়ে উঠে। কার্যত একটা দেশকে শিল্পে সমৃদ্ধ করার জন্য সংরক্ষণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার পদ্ধতিগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১। পরিমাণগত বাধা (quantitative restrictions): সরকার আমদানির উপর পরিমাণগত নিয়ন্ত্রণ ধার্য করার মাধ্যমে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারেন। এতে প্রত্যক্ষভাবে আমদানির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে আমদানির মোট পরিমাণ সীমাবদ্ধ থাকে।
২। শুল্ক (tariff): শুল্ক হল নির্ধারিত আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর ধার্য্যকৃত নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ। সরকার কর্তৃক আমদানির উপর আরোপিত করকে শুল্ক বলে। এর ফলে আমদানিকৃত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এতে করে বিদেশী দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস ও দেশীয় দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিদেশী প্রতিযোগিতার হাত হতে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই সংরক্ষণমূলক আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়।
৩। আমদানি লাইসেন্স (import license): আমদানি লাইসেন্সের মাধ্যমে কোন পণ্য কী পরিমাণ আমদানি করা হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। পণ্যসমূহ যে পরিমাণ আমদানি করতে সরকার ইচ্ছে প্রকাশ করে, সে পরিমাণ অনুযায়ী লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ফলে আমদানির মোট পরিমাণ নির্ধারিত থাকে।
৪। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ (foreign exchange control): অন্য দেশের মুদ্রা করের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করাকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ বলে। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে আমদানিকারক বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন অনুভব করে। কিন্তু যখন সহজে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা যায় না, তখন সহজেই আমদানি নিয়ন্ত্রিত হয়।
৫। কাঁচামাল রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ (control of raw materials export): দেশীয় শিল্পে ব্যবহৃত দেশীয় কাঁচামাল রপ্তানির উপর শুল্ক আরোপ করার ফলে বিদেশে রপ্তানির প্রবণতা কমে যায়। যার ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা কম দামে নিজ দেশ থেকে কাঁচামাল ক্রয় করার সুবিধা পায় এবং শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ও হ্রাস পায়।
৬। আমদানি নিষিদ্ধকরণ (import prohibition): সরকার দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কারণেও কোনো বিশেষ পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করতে পারেন। কিছুকাল পূর্বে সোভিয়েত রাশিয়ার চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কারখানার দুর্ঘটনার পর রাশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে শিশু খাদ্যসহ সকল প্রকার পণ্যদ্রব্য আমদানি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
৭। কোটা (quota): কোটা হল সরকার আরোপিত একটি বাণিজ্য সীমা। অর্থাৎ একটি দেশ কি পরিমাণ আর্থিক মূল্যের পণ্যসমূহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমদানী বা রপ্তানী করতে পারে, তা নির্ধারণ করার আনুপাতিককে কোটা বলা হয়। এর মাধ্যমে আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এ জন্য সংরক্ষণমূলক বাণিজ্যে এই কৌশল ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৮। দেশীয় উদ্যোক্তাদের ভর্তুকি প্রদান (bounties and subsidies): অনেক সময় সরকার বিদেশী প্রতিযোগিতার হাত থেকে দেশীয় পণ্যকে রক্ষা করার জন্য দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক সাহায্য এবং ভর্তুকি প্রদান করে থাকেন। এর ফলে স্বল্প ব্যয়ে পণ্যসমূহ উৎপাদন করতে সফল হয়।
৯। মুদ্রা অবমূল্যায়ন (currency devaluation): দেশীয় মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসকে মূদ্রার অবমূল্যায়ন বলে। মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে দেশীয় মুদ্রার মূল্যমান হ্রাস পায়। এর ফলে আমদানি পণ্যসমূহের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
১০। বৈষম্যমূলক পরিবহন ভাড়া (discriminatory transport fares): দ্রব্য সামগ্রীর আমদানি উৎসাহিত না করার লক্ষ্যে অনেক সময় বৈষম্যমূলক পরিবহণ ভাড়া আরোপ করা হয়। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে দ্রব্যের চাহিদাও স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়।
১১। দেশী পণ্য ক্রয় শ্লোগান (buy local product slogan): দেশীয় জনগণকে জাতীয় চেতনায় অনুপ্রাণিত করে, ‘দেশী পণ্য, কিনে হও ধন্য’ – শ্লোগান প্রচার করে অনেক সময় বৈদেশিক পণ্য বর্জন করা হয়। এর ফলে দেশীয় পণ্যের প্রতিষ্ঠান বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।
১২। বিভেদমূলক সংরক্ষণ নীতি (discriminatory protection policy): সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী আমদানির উপর বিভেদমূলক শুল্ক আরোপ করে। এক দেশের আমদানির উপর অধিক শুল্ক এবং অন্য দেশের আমদানির উপর স্বল্পহারে শুল্ক আরোপ করা হলে তাকে বিভেদমূলক সংরক্ষণ নীতি বলে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাধা সৃষ্টি হয়। এতে দেশীয় উদ্যোগক্তাগণ সংরক্ষণ সুবিধা ভোগ করতে সফল হয়।
১৩। রাজস্বমূলক প্রতিবন্ধক (fiscal constraints): সরকার দেশীয় দ্রব্যসমূহ উৎপাদন ও বিক্রয়ের উপর করের পরিমাণ কম এবং উদ্যোক্তাদের আয়ের উপর কর হ্রাস করে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ফলে বিদেশী দ্রব্যের তুলনায় দেশীয় দ্রব্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় কম পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, উপর্যুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে বাণিজ্যে সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে যে কোন দেশের জাতীয় উন্নয়ন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। [শারমিন জাহান সায়মা]
সহায়িকা: জোয়ারদার, সুকেশ চন্দ্র; আলম, মোঃ শাহ; আখতার, সুফিয়া ও ইসলাম, মোঃ নজরুল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, (২০২০), মিলেনিয়াম পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১২২ – ১২৩।
বাণিজ্য সংরক্ষণ পদ্ধতির বিবরণ
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL