ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের ধাপ | Cost-Benefit Analysis Steps
ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের কিছু পদক্ষেপ বা ধাপ রয়েছে। যা প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অংশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। নিচে ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের ধাপ বা প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. প্রকল্পের লক্ষ্য সংজ্ঞায়ন (definition of project objectives) : প্রকল্পের লক্ষ্য সংজ্ঞায়ন হল ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের প্রথম ও প্রদান ধাপ। প্রকল্পের লক্ষ্য কিভাবে অর্জন করা হবে? নতুন মূলধন ও সরঞ্জাম প্রয়োজন আছে কিনা? ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতাসমূহ কি কি? ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে প্রকল্পের লক্ষ্য নির্ণয় করা হয়।
২. পরিধি সংজ্ঞায়ন (scope definition) : প্রকল্পের লক্ষ্য নির্ণয় করার পরে এর পরিধি কি ধরনের হতে পারে, তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট কিনা? প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারা কারা উপকৃত হবে এবং তাদের অংশগ্রহণ কিভাবে নিশ্চিত করা হবে? প্রকল্পের আয়তন কি রূপ হবে? এ সকল বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করে পরিধি নির্ণয় করা হয়।
৩. ব্যয় ও সুবিধাসমূহ চিহ্নিতকরণ (identification of cost and benefits) : সকল প্রকার ব্যয় ও সুবিধাসমূহ মূল্যায়ন করতে হবে। পরিমাণগত (quantitative) ব্যয় ও সুবিধাদি বাটাকৃত নগদ প্রবাহ বিশ্লেষণের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর গুণবাচক ব্যয় ও সুবিধাদিও যথাযথভাবে বর্ণনা করতে হবে। যেমন- মেশিনারি ক্রয় সংক্রান্ত ব্যয়, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়, নির্মাণ ব্যয়, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ব্যয়, খুচরা যন্ত্রপাতি বাবদ ব্যয় ইত্যাদি পরিমাণগত (Quantitative) ব্যয়ের উদাহরণ। সুতরাং ব্যয়-সুবিধাদি চিহ্নিত করার সময় উভয় ধরনের ব্যয় সুবিধাদি বিবেচনা করতে হবে।
৪. ভবিষ্যৎ ব্যয় ও সুবিধাদি বাট্টাকরণ (factoring in future costs and benefits) : অর্থের সময় মূল্য আছে। যেমন- আজকের দুইশত টাকা আর পাঁচ বছর পরে প্রাপ্ত দুইশত টাকা এক কথা নয়। যদি কাউকে বলা হয় যে (ক) আজকে তাকে দুইশত টাকা দেয়া হবে এবং যদি বলা হয় যে (খ) পাঁচ বছর পর ঐ দুইশত টাকাই তাকে দেয়া হবে। তাহলে সে অবশ্যই প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করবে। কেননা একই পরিমাণ টাকা ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমানে পাওয়া লাভ জনক। যেমন প্রথম প্রস্তাবটির গ্রহণ করে যদি ২০০ টাকা ব্যাংকে পাঁচ বছরের জন্য জমা করা হয়, তাহলে সুদ আসল মিলে যে টাকা হবে তা দ্বিতীয় প্রস্তাবের চেয়ে বেশী হবে। সুতরাং ব্যয়-সুবিধাদি বিশ্লেষণে অর্থের সময় মূল্যকে বিবেচনা করার জন্য ভবিষ্যত ব্যয় ও সুবিধাদিকে বাট্টাকরণ করা হয়।
৫. প্রকল্পের বিকল্পসমূহ চিহ্নিত করা (identify project options) : প্রকল্পের লক্ষ্যসমূহ অর্জন করার জন্য প্রকল্পের বিকল্পসমূহ চিহ্নিত করা হয়। এতে দেখতে হবে অন্য কোন ভাবে একই ফলাফল লাভ করা যায় কিনা। বিকল্পসমূহের সম্ভাব্যতা (feasibility) একটি থেকে অন্যটির পার্থক্য থাকবে। তবে বিকল্পসমূহের সম্ভাব্যতার আলোকে একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যাতে সবচেয়ে বেশী সম্ভাব্য প্রকল্পটি বাছাই করা যায়। সর্বোৎকৃষ্ট প্রকল্পটি বাছাই করার জন্য একটি মূল ঘটনার (base case) সাথে বিকল্পসমূহের সম্ভাব্যতা তুলনা করা হয় এবং যে বিকল্পটি সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্য (match) হয়, সেই বিকল্পটিই সর্বোৎকৃষ্ট প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে পরবর্তী বিকল্পসমূহের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানদন্ড (calculate the decision criteria) : প্রকল্পের আয়ুষ্কালে ব্যয় ও সুবিধাদি বাট্টাকরণের মাধ্যমে বর্তমান মূল্য বের করা হয়, যাতে সার্বিক ব্যয় (overall costs) ও সুবিধাদির মধ্যে তুলনা করা যায়। নীট বর্তমান মূল্য দ্বারা সমাজের সম্পদ সর্বাধিকরণ করা সম্ভব হয়, যার দ্বারা অভ্যন্তরীণ মুনাফার হার (IRR) অর্জন করা যায়। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানদন্ডের মধ্যে মূল্য (NPV) কে আদর্শ মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সূচক (P.I) এর মাধ্যমে সম্ভবপর হয় না। নীট বর্তমান মূল্য সর্বাধিক অর্থনৈতিক রিটার্ন প্রদান করে। যেহেতু প্রকল্পের বাজেটের সীমাবদ্ধতা থাকে, সেহেতু ১ টাকার বিনিয়োগ সর্বাধিক আয় হওয়া উচিৎ। যা নীট বর্তমান পদ্ধতি নিশ্চিত করে। নীট বর্তমান মূল্য ধনাত্নক হলে প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং ঋণাত্মক হলে প্রকল্প বর্জন করা হয়।
৭. সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ (sensitivity analysis) : বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানাবিধ চলকের বিভিন্ন রকম অনুমানের ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফল কতটুকু যৌক্তিক বা দৃঢ়, তা পরীক্ষা করার জন্য সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা হয়। সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণের সময় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনা করা হয়।
ক. বিভিন্ন রকম বাট্টা হারের প্রভাব পরীক্ষা করা;
খ. সম্ভাব্য অনিশ্চয়তার প্রভাব মূল্যায়ন;
গ. যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উপর প্রকল্পের ধনাত্নক ফলাফল নির্ভর করে সে সমস্ত উপাদান নির্ণয় করা।
মোট কথা, প্রকল্প বা প্রস্তাবিত প্রকল্প যদি বিভিন্ন রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও গ্রহণ করা যৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়, তাহলে বিশ্লেষক প্রকল্প সম্পর্কে আশাবাদী হবে।
৮. পছন্দের বিকল্প বাছাই করা (identify preferred option) : সকল প্রকার প্রাসঙ্গিক ফলাফল ও বিভিন্ন ইস্যু পছন্দের বিকল্প বাছাই করার জন্য বিবেচনায় আনতে হবে। সাধারণত উত্তম বিকল্প বাছাই করার জন্য বিভিন্ন বিষয়সমূহ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। যেমন- NPV, IRR, P.I সহ অন্যান্য বিচার্য মানদন্ড দ্বারা গৃহীত বিকল্পসমূহ র্যাংকিং করে (by ranking) বিন্যস্ত করতে হবে। সর্বোৎকৃষ্ট মানদন্ড দ্বারা গৃহীত প্রস্তাবিত প্রকল্পের সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করতে হবে। সুবিধাদি পরিমাণে প্রকাশ যোগ্য নয়, সেগুলো গুণবাচকভাবে বর্ণনা করতে হবে ইত্যাদি।
৯. প্রতিবেদন তৈরি (prepare report) : ব্যয়-সুবিধাদি বিশ্লেষণের চুড়ান্ত ধাপ হলো প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। আর প্রতিবেদনে যে বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকে, তা হলো:
ক.মূল্যায়নের নির্বাহী সারসংক্ষেপ;
খ. মূল্যায়নের পটভূমি;
গ. প্রকল্প/প্রস্তাবিত প্রকল্পের উদ্দেশ্য;
ঘ.মূল্যায়নে যা বিবেচনা করা হয়েছে;
ঙ.বিকল্পসমূহের বিবরণ;
চ. সকল ধরনের ব্যয় ও সুবিধাদি চিহ্নিতকরণ;
ছ. বার্ষিক ব্যয় ও নগদ অন্তপ্রবাহ,
জ. মূল্যায়নের ফলাফল,
ঝ. সংবেদনশীলতা পরীক্ষার ফলাফল;
ঞ গুণবাচক ব্যয় ও সুবিধাদির বর্ণনা,
ট. পছন্দের বা সর্বোৎকৃষ্ট বিকল্প বাছাই,
ঠ. প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপরে বর্ণিত ধাপসমূহ অনুসরণ করে প্রকল্প বা প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় সুবিধাদির বিশ্লেষণ করে সর্বোৎকৃষ্ট প্রকল্প বাছাই করা হয়। [শারমিন জাহান সায়মা]
✅ ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের পদক্ষেপ
✅ ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের পদ্ধতি
সহায়িকা: রাসুল, ড. মো: সিরাজুর এবং ইসলাম, মো: নজরুল, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, (২০১৬/১৭), কমার্স পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL