স্নায়বিক বৈকল্যজনিত শারীরিক সমস্যা

স্নায়বিক বৈকল্য হলো মানব দেহের এমনই কতিপয় শারীরিক সমস্যা, যাদের ফলে কথা বলার সময় মানুষের মুখের বাচনভঙ্গি আসে না অর্থাৎ মুখ অনড় থাকে, মাংসপেশিতে টান পড়ে বা ব্যথা হয়, নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়, স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে, প্রভৃতি নানাবিধ উপসর্গ দেখা যায়। স্নায়ুবিক বৈকল্যজনিত শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে যে সব লক্ষ করা যায়, সে সব হলো – প্যারালাইসিস, এপিলেপসি, এবং পারকিনসন রোগ। নিম্নে এ রোগগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

(ক) প্যারালাইসিস (paralysis): শরীরের কোন অংশের ঐচ্ছিক মাংসপেশি ইচ্ছা মতো নাড়তে পারার ক্ষমতা নষ্ট হওয়াকে প্যারালাইসিস বলে। সাধারণত মস্তিষ্কের কোন অংশের ক্ষতির কারণে ঐ অংশের সংবেদন গ্রহণকারী পেশিগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। যে কোনো ব্যক্তির আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ প্যারালাইসিস হতে পারে, ফলে শরীরের একপাশে কোন অঙ্গ অথবা উভয় পাশের অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। যেমন- দুই হাত ও পায়ের প্যারালাইসিস।
প্যারালাইসিসের কারণ: প্যারালাইসিস সাধারণত স্ট্রোকের কারণে হয়। এছাড়া মেরুদণ্ড কিংবা ঘাড়ের সুষুম্নাকান্ড আঘাত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্যারালাইসিস হতে পারে। স্নায়ু রোগ, সুষুম্নাকাণ্ডের কিংবা কশেরুকার ক্ষয় রোগও প্যারালাইসিসের কারণ হতে পারে।

প্যারালাইসিস (paralysis)
চিত্র: বিভিন্ন প্রকারের প্যারালাইসিস (paralysis), সূত্র: johari Medtech

(খ) এপিলেপসি (epilepsy): এপিলেপসি মস্তিষ্কের একটি রোগ, যাতে আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরে খিঁচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী অজ্ঞান হয়ে পাড়ে। এই রোগকে মৃগী রোগও বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, শরীর কাঁপুনি ও খিঁচুনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আগুন বা পানির সাথে এপিলেপ্সির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু রোগাক্রান্ত অবস্থায় কোথাও পড়ে গেলে রোগী নিজ শক্তিতে উঠতে পারে না। এই কারণে এসব রোগীকে জলাশয় কিংবা আগুন কিংবা অন্যান্য বিপজ্জনক বস্তু বা স্থান থেকে দূর রাখতে হয়।

এপিলেপসির কারণ: এপিলেপসির মূল কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের মৃগী রোগ দেখা দেয়। মাথায় আঘাতের কারণে ম্যানিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস, জন্মগত মস্তিষ্কের বিকৃতি, টিউমার, ইত্যাদি কারণেও এপিলপসির উপসর্গ দেখা দেয়। এপিলেপসি যে কোনো বয়সে হতে পারে। কোনো কোনো এপিলপসির কোনো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নেই, আবার কোনটা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্বাবধানে এপিলেপসির ধরন নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করা প্রয়োজন।

এপিলেপসি (epilepsy)
চিত্র: এপিলেপসি (epilepsy) এর ধরন, সূত্র: Apollo

(গ) পারকিনসন রোগ (parkinson’s disease): পারকিনসন রোগ মস্তিষ্কের এমন একটি অবস্থা, যেখানে হাতে ও পায়ের কাঁপুনি হয় এবং আক্রান্ত রোগীর নড়াচড়া, ও হাঁটাহাঁটি করতে সমস্যা হয়। এ রোগ সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পরে হয়। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে যুবক-যুবতিদেরও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোগটি তার বংশে রয়েছে বলে ধরা হয়।

স্নায়ুকোষ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে থাকে, যার একটি হলো ডোপামিন। ডোপামিন শরীরের পেশির নড়াচড়ায় সাহায্য করে। পারকিনসন রোগাক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কে ডোপামিন তৈরির কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। ডোপামিন ছাড়া ঐ স্নায়ু কোষগুলো পেশি কোষগুলোতে সংবেদন পাঠাতে পারে না। ফলে মাংসপেশি তার কার্যকরিতা হারায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পারকিনসনের কারণে রোগীর মাংসপেশি আরও অকার্যকর হয়ে উঠে, ফলে রোগীর চলাফেরা, লেখালেখি, ইত্যাদি কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

 পারকিনসন রোগ (parkinson's disease)
চিত্র: পারকিনসন রোগের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সূত্র: hksh.com

পারকিনসন রোগ সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকট রূপ দেখা দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগী হালকা হাত বা পা কাঁপা অবস্থায় থাকে। ফলে চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। এছাড়া চোখের পাতা কাঁপুনি, কোষ্টকাঠিন্য, খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া, সোজাসুজি হাঁটার সমস্যা, কথা বলার সময় মুখের বাচনভঙ্গি না আসা অর্থাৎ মুখ অনড় থাকা, মাংশপেশিতে টান পড়া বা ব্যথা হওয়া, নড়াচড়ায় কষ্ট হওয়া, যেমন – চেয়ার থেকে উঠা কিংবা হাঁটতে শুরু করার সময় অসুবিধা হওয়া, এই ধরনের নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।

স্নায়বিক বৈকল্যজনিত উল্লেখিত শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি গ্রহণ, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করার মাধ্যমে রোগী অনেকটা সুস্থ থাকে। [ইশরাত জাহান মিম]


সহায়িকা: জীববিজ্ঞান, বোর্ড বই (নবম-দশম), পৃষ্ঠা ২২৫, ২২৬।


স্নায়বিক বৈকল্যজনিত শারীরিক সমস্যাগুলো কি কি?


Leave a Reply