১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় ও যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ

মুসলিম লীগ ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে এ দলটি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের মাত্র সাত বছরের মধ্যেই দলটি পূর্ব বাংলার জনগণের আস্তা হারায় এবং ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।

উল্লেখ্য যে, ক্ষমতাসিন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়। তাঁদের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক দল, নেজাম ইসলামি ও গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী ফ্রন্ট গঠন করা হয়। যা যুক্তফ্রন্ট নামে পরিচিত। নিন্মে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় ও যুক্তফ্রন্টের সাফল্যের বা বিজয়ের কারণ আলোচনা করা হলো।

১. মুসলিম লীগের দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আদর্শগত কোন্দল: পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট আকার ধারন করে। ফলে অচিরেই পূর্ববাংলার জনগণের মুসলিম লীগের প্রতি মোহভঙ্গ হয়। প্রগতিশীল নেতা কর্মীগণ মুসলিম লীগের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হয়ে নতুন নতুন বিরোধী দল গঠন করায় মুসলিম লীগ দুর্বল হয়ে পড়ে।

২. ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: ১৯৪৭ সালের পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করলে পূর্ববাংলার আপামর জনসাধারণ মুসলিম লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এর ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে, যার পরিণতিতে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়।

৩. মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক মনোভাব: ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে পরাজয়ের ফলে মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে নির্বাচন ভীতি দেখা দেয়। এমতাবস্থায় মুসলিম লীগ ১৯৫১ সালের পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্থগিত রেখে প্রাদেশিক আইনসভার মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধি করে। মুসলিম লীগের এ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

৪. স্বায়ত্তশাসনের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন: ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের উপর শোষণ ও জাতিগত নিপীড়ন শুরু করে। যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে ২১ দফা কর্মসূচি সম্বলিত আন্দোলন শুরু করলে জনমনে আবেদন সৃষ্টি হয়, ফলে মুসলিম লীগের পরাজয় ঘটে।

৫. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ: পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এতে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ তাদের ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হওয়ায় জনগণ এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিপক্ষে ও যুক্তফ্রন্টের পক্ষে রায় প্রদান করে।

৬. মুসলিম লীগের প্রশাসনিক ব্যর্থতা: মুসলিম লীগ শাসনমলে খাদ্য সংকট, লবণ ও বন্যা সমস্যা এবং পাট কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। অপরদিকে, যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ তাদের ২১ দফা কর্মসূচিতে এ সকল সমস্যার সমাধানের নিশ্চয়তা প্রদান করায় পূর্ব বাংলার জনগণ উদ্দীপ্ত হয়।

৭. জোট গঠন: ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় মুসলিম লীগকে সহজেই পরাজিত করা সম্ভব হয়।

৮. মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণির বিকাশ: পাকিস্তান সৃষ্টির পরে পূর্ব বাংলার অধিকাংশ হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী ও বুদ্ধিজীবী ব্যাপক হারে ভারতে চলে যায়। এ শূন্যস্থান পূরণের জন্য উঠতি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এ বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাথে অতি শীঘ্রই উর্দুভাষী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ দ্বন্দ্বে সচেতন মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি মুসলিম লীগের পরিবর্তে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের পথ বেছে নেয়।

৯. সংবিধান প্রণয়নের ব্যর্থতা: ক্ষমতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হন। এর ফলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পায়। অপরদিকে, যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ অতিদ্রুত সংবিধান প্রনয়নের প্রতিশ্রুতি দিলে পূর্ব বাংলার জনগণ যুক্তফ্রন্টের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়।

সুতরাং উপরের উল্লেখিত বিশেষ কারণের সাথে আরও কতিপয় যুক্তসঙ্গত কারণে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এরপর মুসলিম লীগ আর কোন দিনই পূর্ব বাংলার জনগণকে আকৃষ্ট করে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। [ইশরাত জাহান মিম]


সহায়িকা: উদ্দিন, ড. আফজাল; বিল্যাহ, মোহাঃ মুস্তানছির; আলম, মোঃ মাহবুবুল, (২০২০), ইসলামের ইতিহাস, ঢাকা: গ্রন্থকুটির, পৃষ্ঠা ২৫, ২৫৮।


১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারণ


Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL


Leave a Reply