ইসলামের নবী : হযরত মুহাম্মদ (স.) – এর জীবন ও কর্ম

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মকালে আরবের সমাজে মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, প্রভৃতি অরাজকতাসহ ভয়াবহ ও জঘন্য অবস্থা বিরাজমান ছিল। তখন আরবের অধিবাসীগণ এক স্রষ্টা বা আল্লাহর ইবাদতের পরিবর্তে বিভিন্ন দেব-দেবী ও প্রকৃতির পূজায় নিমজ্জিত ছিল। কাব্যচর্চা, গান ও বাগ্মীতায় অগ্রগামী হলেও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে আরবের সমাজ অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। তখন হাটে-বাজারে পণ্যের মত করে মানুষ ক্রয়-বিক্রয় হয়েছিল। দুই একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া তখনকার আরব সমাজে নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার ছিল না। এরূপ পরিস্থিতিতে মানুষকে সহজ, সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। 

জন্ম ও পরিচয়: হযরত মুহাম্মদ (স.)  ২০ এপ্রিল ৫৭০ এবং ১২ রবিউল আউয়াল সােমবার মক্কায় (বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত) জন্মগ্রহণ করেন। মুহাম্মদ (স.) পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি মায়ের গর্ভে থাকাকালে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। জন্মের পরে তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ এবং আহমাদ

হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর শৈশব ও কৈশোর: আরবদের বনু সা’দ গােত্রের মেয়ে ধাত্রী হালিমা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু মুহাম্মদকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ-মমতায় লালনপালন করেন। এরপর মা আমিনার কোলে মুহাম্মদ (স.) সীমাহীন আদরযত্নে বড় হতে থাকেন। কিন্তু তাঁর মাত্র ছয় বছর বয়সকালে মা আমিনা মৃত্যুবরণ করেন। অল্প বয়সেই পিতামাতা উভয়কে হারিয়ে ইয়াতিম হয়ে বিশ্বের বুকে তিনি একা, নিঃসঙ্গ ও অসহায় বালক। উম্মে আয়মান নামক একজন পরিচারিকা শিশু মুহাম্মদকে তাঁরই দাদা আব্দুল মুত্তালিবের হাতে তুলে দেন। তাঁর আট বছর বয়সকালে দাদাও তাঁকে ছেড়ে পরলােকগমন করেন। এরপরে মুহাম্মদ তাঁর চাচা আবু তালিবের কাছে বড় হতে থাকেন। তখন তিনি চাচার ব্যবসায়িক কাজে সহযােগিতার পাশাপাশি মেষ চরাতেন।

বুহাইরা নামক পাদ্রির ভবিষ্যত বাণী: ১২ বছর ২ মাস ১০ দিন বয়সকালে হযরত মুহাম্মদ (স.) চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার কাজে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে চাচার সাথে তিনি বসরায় এসে পৌঁছান এবং সেখানে বুহাইরা নামক একজন খ্রিস্টান পাদ্রির সাথে দেখা হয়। ঐ পাদ্রি মুহাম্মদকে দেখে চিনতে পারেন এবং তিনি বলেন, এ মুহাম্মদ হলেন শেষ জামানার নবী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। পাদ্রি তাঁর চাচা আবু তালিবকে বলেন, মুহাম্মদকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিন, কারণ ইহুদিরা তাঁর ক্ষতি সাধন করতে পারে। পাদ্রির পরামর্শ মোতাবেক, চাচা আবু তালিব কয়েকজন পরিচারকের সাথে প্রিয় ভাতিজা মুহাম্মদকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন।

হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর চারিত্রিক গুণাবলী: হযরত মুহাম্মদ (স.) মধ্যে সকল ধরনের ভাল চারিত্রিক গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়। তিনি সকল ধরনের অহংকার, অপব্যয়, অর্থহীন এবং অনৈতিক কথা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেন। তিনি অন্যের দোষ খোঁজে বেড়াতেন না। এমনকি তিনি যে কাউকে লজ্জা দেয়া থেকে সব সময় নিজেকে বিরত রাখতেন। তিনি সর্বদা মানুষের সাথে হাঁসি মুখে কথা বলতেন। তিনি অন্যের ব্যথাতে ব্যথিত হতেন এবং মানবতার কল্যাণে নিজের সম্পদ উদারভাবে ব্যয় করতেন। সকল কাজে ও কথায় তিনি সর্বদা সত্যবাদী ছিলেন। সত্যবাদীতার জন্য সকলেই তাঁকে আল-আমিন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করেন। এক বাক্যে বলা যায় যে, তিনি পৃথিবীর সকল ধরনের প্রাণি ও জীবজন্তুর জন্য একজন উপকারী বন্ধু ছিলেন।

শান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (স.): আরবের ওকাজ নামক মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে ফিজার যুদ্ধ একটানা পাঁচ বছর চলতে থাকে। এ যুদ্ধে বহু লােকের প্রাণহানি ও রক্তারক্তি অবস্থা দেখে হযরত মুহাম্মদ (স.) ব্যথিত হন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য শান্তিকামী কয়েকজন যুবককে নিয়ে তিনি ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক একটি শান্তি সংঘ গঠন করেন। এ শান্তির সংঘের মাধ্যমে তখনকার আরবে চলমান হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি ও হানাহানি বন্ধ করতে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টার ফলে সমাজ জীবনে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। আরবের সকল মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব এবং গােত্রগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এর ফলে তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে যায়। সকলেই হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত করেন।

বহুদিনের পুরাতন কাবা ঘর সংস্কারের কাজ সমাপ্ত হলে পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (কালাে পাথর) স্থাপন করা নিয়ে কুরাইশগণের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গােত্রের প্রত্যেকেই এ পাথর স্থাপনের মত মহৎ কাজের অংশীদার হতে গিয়ে কেউ ছাড় দিতে রাজি হল না। এ নিয়ে গােত্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হল। অবশেষে গোত্রগুলো এ সিদ্ধান্ত নেন যে, আগামী দিন সকালবেলা সবার আগে যিনি কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন, তিনিই এ বিবাদটি মীমাংসা করবেন। সকালবেলা দেখা গেল যে, সবার আগে হযরত মুহাম্মদ (স.) কাবা ঘরে প্রবেশ করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) দেখে সকলেই আনন্দ প্রকাশ করে বলে উঠল যে, ‘আল-আমিন’ এসেছেন, তিনিই সঠিক সিদ্ধান্ত দিবেন। এরপর হযরত মুহাম্মদ (স.) একটি চাদর বিছিয়ে দিয়ে নিজ হাতে পাথরটি চাদরের মাঝখানে রাখেন। তারপর মুহাম্মদ (স.) সকল গােত্রের প্রধানদেরকে ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা গােত্রের প্রধানগণ একত্রে চাদরটি বহন করে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যান। তারপরে মুহাম্মদ (স.) নিজ হাতে পাথরটি কাবা ঘরের দেয়ালে বসিয়ে দেন। ফলে আরব জাতি ঐ সময়ে একটি ভয়ংকর যুদ্ধ হতে বেঁচে যায় এবং গোত্রগুলো  পাথরটি বহন করতে পেরে সম্মানিত হন।

হযরত মুহাম্মদ (স.) নবুয়তপ্রাপ্তি এবং ইসলাম প্রচার: শৈশবকাল থেকে হযরত মুহাম্মদ (স.) মানুষের মুক্তি এবং শান্তির কথা ভাবতেন। তাঁর এ ভাবনা যুবক বয়সে এসে আরও গভীর হতে থাকে। হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরে মুহাম্মদ (স.) তাঁর সাধনা ও ধ্যান আরও বৃদ্ধি করেন। তিনি মক্কার অদূরবর্তী হেরা পর্বতের জাবালে নূর বা হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি হেরা গুহায় একটানা ১৫ বছর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে ৬১০ সালে পবিত্র রমজান মাসের ২৭ তারিখে মুহাম্মদ (স.) নবুয়ত লাভ করেন। নবুয়ত লাভের পর তিনি লােকজনদেরকে এক আল্লাহর পথে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। মক্কার কাফিরগণ তাঁর এ দাওয়াতের কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে তাঁকে গােপনে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ঐ সময় আরবের প্রভাবশালী লোকজন হযরত মুহাম্মদ (স.) এবং তাঁর অনুসারীদেরকে বিভিন্ন নির্যাতন করতে থাকে। তখন হযরত মুহাম্মদ (স.) খুব ধৈর্যের সাথে তাদের অত্যাচার সহ্য করেন। তিনি নীরবে এক আল্লাহর আনুগত্য এবং ইবাদতের প্রতি মানুষকে আহবান করতে থাকেন। অবশেষে হযরত মুহাম্মদ (স.) আরব সমাজের সকল কুসংস্কার দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। [সংকলিত]


Prophet of Islam: Life and Deeds of Hazrat Muhammad (sm)


 

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *