প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণে ইউনিফাইড অ্যাকসেশন ও ডি-অ্যাকসেশন নম্বর পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা — একটি বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ

unified accession, প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণে ইউনিফাইড অ্যাকসেশন ও ডি-অ্যাকসেশন নম্বর পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা  — একটি বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ

প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণ, উপস্থাপন ও গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক নথিভুক্তকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রতিটি প্রত্নবস্তুর পরিচয়, ইতিহাস, অবস্থান, সংগ্রহ-প্রক্রিয়া এবং পরবর্তী সংরক্ষণ-ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ না হলে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের মৌলিক লক্ষ্যই ব্যাহত হয়। এ বিবেচনায় “ইউনিফাইড অ্যাকসেশন ও ডি-অ্যাকসেশন নম্বর” (Unified Accession and De-Accession Number) পদ্ধতির প্রবর্তন আমাদের জাতীয় প্রত্নসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও কার্যকর করার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

বর্তমান বাস্তবতা ও নথিভুক্তকরণের সীমাবদ্ধতা:

বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘর, আঞ্চলিক দপ্তর এবং প্রত্নক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক স্থাবর ও অস্থাবর প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এসব সংগ্রহের নথিভুক্তকরণে কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়েছে—

  • প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অ্যাকসেশন পদ্ধতি বিদ্যমান, যা অসংগতিপূর্ণ।
  • কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি ইন্টিগ্রেটেড ডেটাবেস না থাকায় তথ্যের স্বচ্ছতা ও হালনাগাদকরণ বাধাগ্রস্ত।
  • গবেষণা বা পুনরুদ্ধারে ‘ক্রস-ম্যাচিং’ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
  • একই প্রত্নবস্তু কখনো কখনো ভিন্ন নামে বা ভিন্ন নম্বরে সংরক্ষিত থাকে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
  • এ বাস্তবতায় একটি একীভূত ও আধুনিক অ্যাকসেশন সিস্টেম সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

ইউনিফাইড অ্যাকসেশন সিস্টেম: কাঠামো ও সুবিধা:

বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রস্তাবিত ইউনিফাইড অ্যাকসেশন পদ্ধতিতে প্রতিটি প্রত্নবস্তুকে চারটি অংশে বিভক্ত সংখ্যাসূচক কোড দেওয়া হবে—
১) অবস্থান (জাদুঘর/দপ্তর), ২) শ্রেণি/ধরন, ৩) সাল (সংযোজন), এবং ৪) ধারাবাহিক নম্বর (প্রত্নবস্তুর)।

এর ফলে দেশের যেকোনো জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত্নবস্তু সহজেই শনাক্তযোগ্য হবে এবং জাতীয় পর্যায়ে একটি একীভূত ডিজিটাল রেকর্ড গড়ে উঠবে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে—

  • প্রতিটি প্রত্নবস্তুর পরিচয় হবে বৈশ্বিক মানদণ্ডসম্পন্ন;
  • সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনী ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে; এবং
  • তথ্য-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তত্ত্বাবধান আরও দ্রুত ও নির্ভুল হবে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অ্যাকসেশন ব্যবস্থাপনা:

বিশ্বের শীর্ষ জাদুঘর যেমন – ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লুভর মিউজিয়ামসহ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান Integrated Collection Management System (ICMS) ব্যবহার করে। এ ব্যবস্থায়—

  • RFID/QR কোড–ভিত্তিক ট্র্যাকিং,
  • ৩৬০° ডিজিটাল ইমেজ আর্কাইভ,
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক শনাক্তকরণ,
  • এবং ক্লাউড-ভিত্তিক মাস্টার ডাটাবেস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ইউনিফাইড অ্যাকসেশন সিস্টেম এ আন্তর্জাতিক মানের আধুনিকায়নেরই প্রথম ধাপ বলা যায়।

প্রযুক্তি সংযোজনের সম্ভাবনা ও করণীয়:

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বর্তমান উদ্যোগের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য কিছু আধুনিক প্রযুক্তি বিবেচনা করা যেতে পারে—

১. QR কোড–ভিত্তিক অ্যাকসেশন ট্যাগ – মোবাইল স্ক্যানেই প্রত্নবস্তুর সমস্ত তথ্য দেখা যাবে;
২. ক্লাউড-সাপোর্টেড কেন্দ্রীয় ডাটাবেস – দেশের সব জাদুঘর এক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হবে;
৩. ৩D ডিজিটাইজেশন ও ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তি – ভঙ্গুর বা ক্ষয়িষ্ণু প্রত্নবস্তু সংরক্ষণে অত্যন্ত কার্যকর;
৪. AI-ভিত্তিক ডুপ্লিকেট চেক ও তথ্যঘাটতি শনাক্তকরণ; 
৫. GIS-সমর্থিত প্রত্নবস্তু উৎস ট্রেসিং – প্রত্নবস্তুর আবিষ্কারস্থল ও প্রসঙ্গ নির্ধারণে সহায়ক;

৬. ইউনিফাইড অ্যাকসেশন নম্বরিংকে guidline-সহ বাধ্যতামূলক নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা;
৭. প্রতিটি জাদুঘরের জন্য প্রশিক্ষণ (Training) ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রটোকল (Standard Operating Protocol – SOP) প্রণয়ন;
৮. কেন্দ্রীয় সার্ভার-নির্ভর Museum Management Portal তৈরি;
৯. নতুন প্রত্নবস্তু সংগ্রহের মুহূর্ত থেকেই অ্যাকসেশন নম্বর (Accession number) প্রদান বাধ্যতামূলক করা এবং
১০. ভবিষ্যতে গবেষকদের জন্য ডিজিটাল পাবলিক অ্যাক্সেস প্ল্যাটফর্ম (Digital Public Access Platform) চালু করা।

ইউনিফাইড অ্যাকসেশন সিস্টেম শুধুই একটি নম্বর প্রদান প্রক্রিয়া নয়; এটি বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ ব্যবস্থাপনায় তথ্য-ভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এক নতুন যুগের সূচনা। সঠিক বাস্তবায়ন হলে এটি গবেষণা, সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপস্থাপনাকে এক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করবে—যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।


📚 সহায়িকা:
Inspired by data obtained through a workshop organized by the Department of Archaeology, Dhaka Head Office on 20 November 2025,


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply