ইটাখোলা মুড়া মন্দির ও বিহার: কুমিল্লা ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান

বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলাধীন সদর দক্ষিণ উপজেলায় অবস্থিত ময়নামতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হল ইটাখোলা মুড়া মন্দির ও বিহার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি বিশ্বরোড বাসস্টপ থেকে কুমিল্লা-কালির বাজার নামক আঁকাবাঁকা সড়কপথ ধরে প্রায় ৩ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট কলেজ। এ কলেজের পশ্চিম পাশে একটি ঢিবির উপরে এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির অবস্থান। বৌদ্ধ সভ্যতার এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির ভূ-স্থানাঙ্ক (geo-coordinate) 23°26’19.8″N 91°07’45.7″E (23.438843, 91.129354)I
‘ইটাখোলা মুড়া’ নামে পরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বৌদ্ধ মন্দির ও বিহারের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে বলে জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির দক্ষিণ অংশে বৌদ্ধ মন্দির এবং উত্তর অংশে বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। ইটাখোলা মুড়ার প্রকৃত নাম জানা যায়নি। তবে বহুদিন ধরে এ স্থানটিতে উন্মুক্ত অবস্থায় প্রচুর ইট দেখতে পাওয়ায় স্থানীয়ভাবে ইটাখোলা নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। ধারণা করা হয় যে, আনুমানিক খ্রিস্টীয় সাত থেকে আট শতকের মধ্যভাগে দেব বংশের শাসন আমলে ইটাখোলা মুড়ার বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার নির্মিত।
বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণ কাঠামো সংযোজন, বিয়োজন ও পুন:নির্মাণের মাধ্যমে ইটাখোলা মুড়ার বৌদ্ধ মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। মন্দিরটির আদিতে একটি ভিতের উপর ঐতিহ্যশৈলীতে নিরেটভাবে একটি স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। এ স্তূপের মধ্যস্থলে একটি ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট উপাসনা কক্ষ রয়েছে। এখানেই চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত পূর্ণাবয়ব অক্ষোভ্যের ক্ষতিগ্রস্থ একটি মূর্তি পাওয়া যায়।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন নির্মাণ কাঠামো সংযোজন, বিয়োজন ও পুন:নির্মাণের মাধ্যমে এ মন্দিরটির সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বিশেষ করে, পুরানো স্তূপের উপাসনা কক্ষ বা অক্ষোভ্যের মূর্তিটির অধিষ্ঠানস্থানটি বন্ধ করে দিয়ে পূর্ব দিকে তিনটি নতুন লম্বা ও সঙ্কীর্ণ ভজনালয় (মন্দির) নির্মাণ করা হয়। আর তার ফলে গোটা মন্দির কাঠামোটির আকৃতি আয়তাকার হয়ে উঠে। আয়তাকার মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪১.৪ মিটার এবং প্রস্থ ২৪ মিটার। মন্দিরটির পার্শ্ববর্তী ভজনালয়গুলো একসময় বন্ধ করে দেয়া হয়, কেবল মন্দিরের অন্যান্য অংশের মত এখানে পূজ্য দেবমূর্তি রাখার জন্য কয়েকটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ রাখা হয়েছিল।

মন্দিরটির চারদিকে পরিবেষ্টিত ২.৬ মিটার চওড়া একটি পরিক্রমণপথ এবং এর বাহির দিয়ে ১.২ মিটার চওড়া সীমানা প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সীমানা প্রাচীর পরিবেষ্টিত আঙিনা থেকে মন্দিরটিতে আরোহণের জন্য দীর্ঘ সিঁড়ির পথ রয়েছে। সীমানা প্রাচীরটির অভ্যন্তরের আঙিনায় এবং মন্দিরের পশ্চিম পাশে একটি স্তুপ ও পূর্বদিকে দুই কোণে একটি করে স্তুপের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সীমানা প্রাচীরটির পূর্ব পাশের দীর্ঘ সিঁড়ির শেষে নিচের দিকে তিনটি স্তূপ রয়েছে।
ইটাখোলা মুড়ার বৌদ্ধ মন্দিরটি থেকে ৪৫মিটার উত্তর দিকে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। বর্গাকারে নির্মিত বিহারটির প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৩৯মিটার। বিহারটির মাঝখানে একটি খোলা আঙিনা এবং আঙিনাটির চারদিকে ১৯টি কক্ষ রয়েছে। পূর্বমুখী বিহারটির সামনের দিকে প্রক্ষেপিত একটি প্রবেশ কক্ষ রয়েছে।

প্রত্নস্থানটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ পরিচালনার সময় বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রত্নবস্তু হিসেবে খাঁটি নিরেট সোনার তিনটি গোলাকার গুটিকা ও একটি তাম্রশাসনের কথা জানা যায়। এছাড়া এখানে চুন-সুরকির তৈরি মূর্তিও পাওয়া যায়।
ইটাখোলা মুড়া বৌদ্ধ মন্দির ও বিহারের নির্মাণশৈলীর পরিণত ও বিকশিত রূপ কুমিল্লার শালবন বিহার, নওগাঁর পাহাড়পুর, ভারতের বিক্রমশীলা ও আরও অনেক প্রত্নস্থানে পরিলক্ষিত হয়। এখানকার আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ ও নির্মাণকাঠামোগুলোকে সঙ্গতভাবেই খ্রিস্টীয় সাত থেকে আট শতকের বলে ধারণা করা হয়, যা প্রাচীন বঙ্গ ও সমতট জনপদের অতীত স্মৃতি বহন করে।
The 7th July 1945, Simla (under Ancient Monuments Preservation Act 1904) অনুসারে ইটাখোলা মুড়া মন্দির ও বিহারটি Itakhola নামে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়। এটি বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রনাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভূক্ত ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এছাড়া ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি “The Lalmai – Mainamati Group of monuments” শিরোনামে ইউনেস্কোর (UNESCO) সম্ভাব্য বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় (tentative lists) অন্তর্ভূক্ত অন্যতম প্রত্নস্থান হল ইটাখোলা মুড়া বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার। [মো: শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র :
১. রশীদ, এম হারুনুর, ইটাখোলামুড়া;
২. The Lalmai – Mainamati Group of monuments;
৩. প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
ইটাখোলা মুড়া মন্দির ও বিহার
Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL