ঐতিহ্যের অমূল্য স্মারক: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হরিপুর জমিদারবাড়ি
হরিপুর জমিদারবাড়ি
ঐতিহ্যবাহী হরিপুর জমিদারবাড়ি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর নামক গ্রামে তিতাস নদীর পূর্বপ্রান্তে কালের সাক্ষী হয়ে অবস্থান করছে। এ জমিদারবাড়িটিকে কেউ বলে রাজবাড়ি, আবার কেউ বলে বড়বাড়ি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবপুর নামক বাসস্টোপ থেকে আঁকাবাঁকা সড়কপথ ধরে পশ্চিম দিকে এবং নাসিরনগর উপজেলার শেষ সীমান্তে হরিপুর গ্রামের পশ্চিম পাশে তিতাস নদীর পাড়ে সুরম্য ও সুবিশাল এ বাড়িটি অতীতকালের স্মৃতিবহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় ১৯ শতকে জমিদার গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী হরিপুরের এ জমিদারবাড়ি নির্মাণ করেন। ১২ চৈত্র ১৩৪৩ বাংলা তারিখে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে বাড়িটির উত্তরাধিকার হন হরিপদ রায় চৌধুরী ও শান্তি রায় চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে বাড়ির মালিকানা ও জমিদারি আসে উপেন্দ্র রায় চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায় চৌধুরীর দখলে। আরও জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে এ চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্য জমিদার বাড়িটি ফেলে কলকাতায় চলে যান।
ব্রিটিশ শাসন আমলে নির্মিত হরিপুর জমিদার বাড়িটির নির্মাণশৈলীতে স্থানীয় ও ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রায় ৪.৮০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত দুই তলাবিশিষ্ট জমিদার বাড়িটিতে রং মহল, দরবার হল, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, রান্না ঘর, নাচঘরসহ প্রায় ৬০টি কক্ষ, মল পুকুর, খেলার মাঠ, মন্দির ও সীমানা প্রাচীর এখনও অবিকল রয়েছে।
হরিপুর জমিদার বাড়ির পশ্চিম দিকে তিতাস নদীর পাড়ে পাকা ঘাটলা এবং উত্তর দিকে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী ও দক্ষিণ দিকে গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর উঁচু সমাধি মঠ রয়েছে। লাল ইট ও চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরি এ জমিদার বাড়ির ভবন ও ভবনের সামনে অবস্থিত দুটি উঁচু মঠ বা মন্দির জমিদার বংশের ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। জমিদার বাড়িটির ভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠার জন্য ছয় দিকে ছয়টি সিঁড়ি ও বাড়তি পশ্চিম-উত্তর কোণে ছয়টি শয়নকক্ষ এবং মল পুকুরের পূর্বপাড়ে চারটি ও পশ্চিম পাড়ে চারটি শয়নকক্ষ রয়েছে।
সম্পূর্ণ ইটের গাঁথুনিতে নির্মিত বিশাল আয়তনের এ বাড়িটির কোথাও কোনো রডের ব্যবহার দেখা যায় না। তবে ছাদগুলো নির্মাণে লোহার বীম ও পোড়ামাটির টালি ইটের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এ বাড়ির বাহিরের কারুকার্য খচিত দেয়াল, স্তম্ভ ও কার্নিশ প্রভৃতি অবয়ব রয়েছে। তবে এবাড়ির অধিকাংশ কক্ষেরই পুরাতন দরজা ও জানালায় চৌকাঠ ও কপাট অবশিষ্ট নেই। বাড়িটির দেয়ালের কিছু কিছু স্থানের আস্তর খসে পড়েছে। দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যের অল্প কিছু অংশই এখন টিকে রয়েছে। বাংলাদেশের মেঘনা তথা তিতাস নদী বিধৌত পূর্বপ্রান্তের সমভূমিতে এত বড় প্রাচীন বাড়ি আর কোথাও দেখা যায় না।
দৃষ্টিনন্দন হরিপুর জমিদার বাড়িটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর দর্শনার্থী ভিড় জমায়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তিতাসে যখন পানি থৈ থৈ করে তখন বাড়িটির সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। এক সময় ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হরিপুর জমিদার বাড়ির নদীর ঘাট থেকেই শুরু হতো। এ বাড়িতে মধুমালতি, ঘেটু পুত্র কমলা এবং নাইওরীসহ অনেক খ্যাতনামা চলচ্চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে।
৩১ মে ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী হরিপুর জমিদার বাড়ি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক এ জমিদারবাড়িকে তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক বাড়িটির সীমানা প্রাচীরসহ অভ্যন্তরের ভবনে সংস্কার-সংরক্ষণ কাজ শুরু হয়ে বর্তমানে চলমান রয়েছে।
✍ লেখক: মো. শাহীন আলম
তথ্যসূত্র: প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL