কোর জোন ও বাফার জোন সম্পর্কে ধারণা

কোর জোন (core zone): কোর (core) শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো মূল, অন্তস্তল, কোনো কিছুর কেন্দ্র, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ইত্যাদি। জোন (zone) শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো মণ্ডল, বলয়, স্থল, স্থান, ইত্যাদি। কোর (core)জোন (zone) এ দু’টি শব্দকে একত্রে বলা হয় কোর জোন (core zone)। আভিধানিক অর্থ অনুসারে কোর জোন (core zone) বলতে সাধারণত কোনো কিছুর কেন্দ্রস্থল কিংবা কোনো স্থানের কেন্দ্রস্থল কিংবা কোনো কিছুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে বুঝায়। তবে ব্যবহারিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় বা ক্ষেত্রভেদে কোর জোনের সংজ্ঞার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন –

১। বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে, কোর জোন হলো যে কোনো বনভূমির এমন একটি স্থান, যেখানে প্রকৃত বন বা উদ্ভিদ রয়েছে এবং স্থানটিতে কোনো প্রকারের জনবসতি নেই। আবার এভাবে বলা যায়, কোর জোন মূলত বনভূমির প্রকৃত বন বা উদ্ভিদের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যেখানে বন বিভাগ কর্তৃক বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক বনজ সম্পদের সংরক্ষণ কঠোরভাবে সুরক্ষিত করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রিজার্ভ ফরেস্ট কোর জোনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

কোর জোন ও বাফার জোন সম্পর্কে ধারণা
চিত্র: Conservation Efforts in India এর নির্ধারিত কোর জোন ও বাফার জোন।

২। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, কোর জোন হলো ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এমন একটি নির্ধারিত ও চিহ্নিত স্থান, যেখানে ঐতিহাসিক বাড়ি ও স্থাপনা কিংবা ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা কিংবা ঐতিহাসিক সেতু কিংবা ঐতিহ্য সংরক্ষণ এলাকা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভূ-দৃশ্যগুলোর মত গড়ে উঠা সম্পদ (properties) এবং প্রেক্ষিত বিবেচনায় অন্যান্য স্থাপনা, ভূমি ও বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের কোর জোন (core zone)কে কেউ কেউ ঐতিহ্য সম্পদ এলাকা (heritage property area or heritage property zone) বলেও উল্লেখ করেন।

৩। যুদ্ধ ও বিগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে, কোর জোন হলো এমন একটি স্থান, যেখানে দুই বা ততোধিক পক্ষ সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকে এবং স্থানটিতে কোনো প্রকারের জনবসতি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। আবার যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এ কোর জোনে কখনও কখনও যুদ্ধরত পক্ষগুলো কর্তৃক জনসাধারণের জন্য চলাচল সীমাবদ্ধ (restricted) করে দেয়া হয়ে থাকে।

উপরে উল্লেখিত আলোচনা থেকে কোর জোন (core zone) সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করতে পেরেছি। এবার কোর জোনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাফার জোন (buffer zone) সম্পর্কে জানার ও বুঝার চেষ্টা করবো।

বাফার জোন (buffer zone): বাফার (buffer) শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো ধাক্কা নিবারণের গদি বা স্থান, ঢাল (shield), রক্ষক (protector), বাধা (barrier), প্রতিবন্ধক (defense), বেড় বা বেড়া (encirclement), রক্ষাকবচ (safeguard), বর্ম (armor), ইত্যাদি। জোন (zone) শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো মণ্ডল, বলয়, স্থল, স্থান, অঞ্চল, ইত্যাদি। বাফার (buffer)জোন (zone) এ দু’টি শব্দকে একত্রে বলা হয় বাফার জোন (buffer zone)। আভিধানিক অর্থ অনুসারে বাফার জোন (buffer zone) বলতে সাধারণত কোনো জিনিস বা স্থানকে যে কোনো ধরনের ধাক্কা বা হুমকি বা বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নির্ধারিত স্থানকে বুঝায়।

অর্থাৎ বাফার জোন হলো এক কথায় একটি সুরক্ষা বলয় বা রক্ষাকবচ স্থান, যা যে কোনো ধরনের সম্ভাব্য ধাক্কা বা হুমকি বা বিপদ থেকে কোর জোন (core zone) কে নিরাপদ রাখতে নির্ধারণ করা হয়। বাফার জোনকে আবার নিরাপদ অঞ্চলও বলা হয়ে থাকে। সাধারণত কোর জোনের প্রেক্ষিত বিবেচনায় বাফার জোন নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে ব্যবহারিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় বা ক্ষেত্রভেদে বাফার জোনের সংজ্ঞার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন –

১। বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে, বাফার জোন হলো যে কোনো বনভূমির মূল স্থানের বা কোর জোনের সুরক্ষার জন্য চারদিকে নির্ধারিত এমন স্থান, যেখানে মানুষ কর্তৃক প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন: ভূমি বা জলের ব্যবহারের পাশাপাশি বনভূমির প্রকৃতি সংরক্ষণ করা হয়। এ জোনের মধ্যে টেকসই কৃষি, বনায়ন, ইকোট্যুরিজম, চিত্তবিনোদনসহ অন্যান্য কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। বাফার জোনে সাধারণত গ্রামবাসী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী সহাবস্থান করে।

২। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, বাফার জোন হলো ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন যে কোনো স্থানের সুরক্ষার জন্য এর চারদিকে নির্ধারিত এমন স্থান, যেখানে মানুষের সকল প্রকারের উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়ে থাকে। একটি বাফার জোন হলো যে কোনো প্রকারের প্রত্ন-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্থান বা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্থানকে ঘিরে থাকা একটি এলাকা, যা ঐতিহ্য স্থানটির সুরক্ষার জন্য একটি অতিরিক্ত স্তর বা বলয় হিসেবে কাজ করে। বাফার জোনে সাধারণত নির্ধারিত ঐতিহ্য স্থান সংলগ্ন চারদিকের বিন্যাস (setting), গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য (views) এবং প্রেক্ষিত বিবেচনায় অন্যান্য ক্ষেত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে, যেগুলো ঐতিহ্য স্থানটির সুরক্ষার সহায়ক হিসেবে কার্যকরীভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে, ইউনেস্কো (UNESCO) এর শর্ত পূরণ করার জন্য ঐতিহ্য স্থানের বাফার জোন নির্ধারণ করে একটি মানচিত্রে সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত করার প্রয়োজন হয়, যেখানে মানুষের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের (WHS) বিন্যাস (setting) বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং বাফার জোনটি নির্দেশ করার জন্য সংশ্লিষ্ট একটি নীতি থাকার প্রয়োজন হয়।

প্রত্ন-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্থান বা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্থানের চারদিকে বাফার জোন নির্ধারণ করে এমনভাবে সকলের দৃষ্টিগোচর করা যেতে পারে, যেখানে ডেভেলোপার (developers) এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীগণ (decision-makers) কর্তৃক যে কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গ্রহণের পূর্বে ঐতিহ্য স্থানের উপরে সম্ভাব্য প্রভাবগুলো (potential impacts) সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে পারে। যদিও বাফার জোন ইউনেস্কো কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত কোনো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অংশ নয়, তবে ডেভেলোপার (developers) এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীগণ (decision-makers) কর্তৃক সম্ভাব্য যে কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর আরোপিত পরিপূরক আইনি এবং প্রথাগত বিধিনিষেধ।

কোর জোন ও বাফার জোন
চিত্র: বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলার লাইমাই পাহাড়ে অবস্থিত কুটিলা মুড়া নামক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের কোর জোন ও বাফার জোনের উদাহরণ।

সুতরাং বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের (WHS) বিন্যাস (setting) সুরক্ষা করার জন্য বাফার জোন নির্ধারণ করা হয়। বাফার জোন হলো ঐতিহ্য স্থানের সংলগ্ন পরিবেশ, যা বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান এবং এর বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য দেখার এবং উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অবদান রাখে। বাফার জোন নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান – এর দিকে এবং থেকে দৃশ্যমানতা (visibility to and from), শহুরে এলাকাসহ ভূমি ব্যবহার বিন্যাসের বিশ্লেষণ বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

চিত্র: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে ‘বেলজিয়াম’ ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যে বাফার স্টেট। সূত্র: legallegacy.

৩। যুদ্ধ ও বিগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে, বাফার জোন হলো সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত দুই বা ততোধিক পক্ষ বা দেশের মাঝখানে অবস্থিত নিরপেক্ষ বা সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রক একটি স্থান বা দেশ। সাধারণত দুই বা ততোধিক শক্তিশালী পক্ষ বা দেশের মধ্যবর্তী নিরপেক্ষ কিংবা সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রক পক্ষ বা দেশ, যা আয়তনে ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ হতে পারে। দু’টি বিবদমান দেশের মধ্যে সংঘর্ষ বা যুদ্ধ এড়ানোর জন্য দুই দেশের মাঝখানে যে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ রাষ্ট্র বা দেশের অবস্থান থাকে, সে রাষ্ট্র বা দেশকেই বাফার স্টেট (buffer state) বলা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে ‘বেলজিয়াম’ ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যে বাফার স্টেট হিসেবে কাজ করেছে। রাশিয়া এবং NATO ব্লকের মধ্যে ‘ইউক্রেন’ বাফার স্টেট হলেও বর্তমানে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইউক্রেন’ কোর জোন বা কোর স্টেট (core state) হিসেবে অবস্থান করছে। [মো: শাহীন আলম]


সহায়িকা:
১। CORE ZONE VS THE BUFFER ZONE IN THE TIGER RESERVE
২। Confused About The Core Zone And The Buffer Zone In The Tiger Reserve ?
৩। Buffer Zone
৪। Policy Compendium
৫। Merriam-Webster


কোর জোন ও বাফার জোন কি?


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply