ক্লাউড সিডিং | Cloud Seeding
ক্লাউড সিডিং কি এবং কেন?
‘ক্লাউড সিডিং (cloud seeding)’ এর বাংলা ‘কৃত্রিম বৃষ্টিপাত’। ‘কৃত্রিম বৃষ্টিপাত’ হলো বৈজ্ঞানিক কৌশলে আবহাওয়ার পরিবর্তন করে সংঘটিত বৃষ্টিপাত। সাধারণত মেঘ ও বৃষ্টিবিহীন এলাকায় প্রথমে মেঘ সৃষ্টি করা হয়; দ্বিতীয় পর্যায়ে মেঘকে বৃষ্টির উপযোগী করা হয় এবং শেষে মেঘ গলিয়ে বৃষ্টি ঝরানো হয়। তবে ক্লাউড সিডিং এর লক্ষ্য হলো বৃষ্টিপাতের ও তুষারপাতের পরিমাণ কমানো বা বাড়ানো, বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি কমানো, এবং কুয়াশাকে ছড়িয়ে দেয়া। কখনও কখনও দেখা যায় যে, আকাশে মেঘ আছে, কিন্তু বৃষ্টি নেই এরূপ ক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করে ভাসমান মেঘকে জলের ফোঁটায় পরিণত করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়।
ক্লাউড সিডিং এর উদ্ভাবক কে?
জানা যায়, ১৯৪৬ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট সেইফার সর্বপ্রথম ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের কথা চিন্তা করেন। তিনি সর্বপ্রথম বাতাসের জলীয় বাষ্পকে জমাট বাঁধিয়ে মেঘ বানাতে সক্ষম হন। এ কাজে তিনি কার্বন ডাই-অক্সাইডের টুকরো শুষ্ক বরফ (dry ice) ব্যবহার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কশায়ার পাহাড়ের কাছে তিনি ড্রাই আইস ছুঁড়ে দিয়ে তুলোর মতো মেঘ বানাতে সক্ষম হন। আর এ কারণেই তাঁকে কৃত্রিম মেঘের জনক বলা হয়।
ক্লাউড সিডিং কিভাবে ঘটানো হয়?
জানা যায় যে, ক্লাউড সিডিং (কৃত্রিম বৃষ্টিপাত) – এর জন্য মূলত রেফ্রিজারেটরের মূলনীতি প্রয়োগ করা হয়। ভূমি থেকে রকেট ছুড়ে, এবং বিমান ব্যবহার করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। এ কাজে সর্বাধিক ব্যবহৃত রাসায়নিক যৌগটি হলো সিলভার আয়োডাইড (AgI)। কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাধারণত যে সব কৌশল প্রয়োগ করা হয়:
⇒ আকাশে মেঘও নেই এবং বৃষ্টিও নেই, এরূপ ক্ষেত্রেঃ
প্রথম পর্যায়েঃ বায়ুর আর্দ্রতাকে ঘনীভূত করা হয় –
যে সব এলাকায় বৃষ্টি প্রয়োজন, সে সব এলাকায় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে মেঘ সৃষ্টি করা হয়। ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ইউরিয়া এবং লবণ মিশ্রিত একটি রাসায়নিক পদার্থ অথবা ইউরিয়ার সাথে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মিশিয়ে প্রস্তুতকৃত রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে মেঘ সৃষ্টি করা হয়। এ রাসায়নিক পদার্থ বায়ু থেকে আর্দ্রতা নিয়ে ঘনীভবন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটায়।
দ্বিতীয় পর্যায়েঃ মেঘে রূপান্তর করা হয় –
রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে মেঘপুঞ্জ তৈরি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় খাবার লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড, টি-১ ফর্মুলা, ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, শুকনো বরফ (dry ice) এবং কখনও কখনও ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ব্যবহার করা হয়। এতে মেঘ দ্রুত ঘনীভূত হয় এবং তা পতনশীল অবস্থায় পৌছায়।
শেষ পর্যায়েঃ বৃষ্টিপাত ঘটানো হয় –
ভূমি থেকে রকেট ছুড়ে কিংবা বিমানের সাহায্যে মেঘের উপরে সিলভার আয়োডাইড নামক রাসায়নিক পদার্থের স্ফটিকদানা বা কখনও কখনও শুকনো বরফ (dry Ice) ছিটিয়ে দিয়ে মেঘধৃত আর্দ্রতাকে বড় বড় পানির ফোঁটায় পরিণত করা হয়, যা আর বাতাসে ভাসতে না পেরে মাটিতে নেমে আসে এবং বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়।
⇒ আকাশে মেঘ আছে কিন্তু বৃষ্টি নেই এরূপ ক্ষেত্রেঃ
ভাসমান মেঘ লক্ষ্য করে রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। দেখা যায়, আকাশে মেঘ আছে, অথচ বৃষ্টি হয় না। সাধারণত মেঘে তুষার কণা জমে অতিশীতল (supercooling) অবস্থার সৃষ্টি হয়, ফলে জলীয় (watery) অবস্থায় আর থাকে না। তখন বিমান থেকে সিলভার আয়োডাইডের স্ফটিকদানা বা শুষ্ক বরফ (dry Ice) নামক রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে কিংবা রাসায়নিক পদার্থপূর্ণ রকেট ছুড়ে অতিশীতল অবস্থা নষ্ট করে দেয়া হয়; মেঘ তখন জলে (পানি) পরিণত হয় এবং বৃষ্টির ফোঁটা আকারে পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে পড়ে।
ক্লাউড সিডিং ব্যবহারের উপকারিতা কি কি?
সীমিত প্রাকৃতিক জলবিশিষ্ট এলাকায় ক্লাউড সিডিং একটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের শুষ্ক জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সাহায্য করার উপায় হিসেবে ক্লাউড সিডিং (কৃত্রিম বৃষ্টিপাত) এর সুপারিশ করেন বলে জানা যায়।
কৃত্রিম বৃষ্টিপাত বিশ্বের শুষ্ক ও শুষ্কপ্রায় বিভিন্ন দেশের জন্য আশার বাণী নিয়ে এসেছে। চীন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে বলে জানা যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও চীনের উত্তরাংশে বৃষ্টিপাত সাধারণত খুবই কম এবং পানির অন্যান্য উৎসগুলোর অবস্থাও খুবই খারাপ। এরূপ অবস্থায় ক্লাউড সিডিং কাজে লাগিয়ে তারা ইচ্ছে মতো বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে চীনের উত্তরাংশের নদ-নদীর পানি ১৩% পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। আরও জানা যায় যে, ২০০৮ সালে চীনের বেইজিং অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে বৃষ্টিমুক্ত রাখতে ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়।
ক্লাউড সিডিং এর খারাপ প্রতিক্রিয়া কি কি?
ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া আছে কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে এবং গবেষণা চলন্ত রয়েছে। এ প্রক্রিয়া নিয়ে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলো অভিযোগ এনেছে বলে জানা যায়। এসব দেশের অভিযোগ হলো যে, এ পদ্ধতিতে তাদের বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প টেনে নেয়া হচ্ছে। যথেচ্ছা কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের এরূপ ব্যবস্থা বৈশ্বিক উষ্ণায়নও ঘটাতে পারে বলে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন বলে জানা যায়। [মো. শাহীন আলম]
Ref. & Image Source: wikipedia.org