খনিজের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

প্রাকৃতিক উপায়ে কয়েকটি মৌলিক উপাদান পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে যে যৌগিক পদার্থ সৃষ্টি করে, তাকে খনিজ (Mineral) বলা হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংযুক্তি ও সুনির্দিষ্ট পারমাণবিক গঠনবিশিষ্ট অজৈব সমসত্ব পদার্থই খনিজ।

কিছু খনিজ কেবল একটি উপাদান দিয়েই গঠিত হয়, যেমন—সোনা, রূপা, তামা, হীরা, গন্ধক ইত্যাদি। এগুলোর গঠনে থাকা রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মূল উপাদান থেকে ভিন্ন রূপ ধারণ করে।

খনিজকে সাধারণত তার বর্ণ, কঠিনতা, আকৃতি, দ্যুতি (উজ্জ্বলতা), সম্ভেদ বা ফাটল, আপেক্ষিক গুরুত্ব ইত্যাদি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং রাসায়নিক গঠনের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি খনিজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও রাসায়নিক গঠন রয়েছে।

খনিজের বৈশিষ্ট্য

১। স্ফটিকাকার গঠন (Crystal Form):
বেশিরভাগ খনিজ স্ফটিকাকার, অর্থাৎ খনিজের পরমাণুগুলো একটি নির্দিষ্ট জ্যামিতিক বিন্যাসে সজ্জিত থাকে। স্ফটিকের গঠন প্রিজম, ঘনক (কিউব), অষ্টতলক বা চতুস্তলক প্রভৃতি আকার ধারণ করতে পারে।

  • কোয়ার্টজ স্ফটিক সাধারণত ষড়ভুজাকৃতি ও পিরামিডের মতো দেখায়।
  • হীরা ও ম্যাগনেটাইটের স্ফটিক অষ্টতলক গঠন বিশিষ্ট।

২। সম্ভেদ (Cleavage):
খনিজে ফাটল বা সম্ভেদ দেখা যায়, যা খনিজ শনাক্তে সহায়তা করে।

  • গ্যালিনার সম্ভেদ সমমাত্রিক।
  • অভ্র (Mica)-এর সম্ভেদ কেবল একদিকে, ফলে এটি সহজেই পাতলা স্তরে বিভক্ত হয়।

৩। কঠিনতা (Hardness):
খনিজের কঠিনতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

  • নখ দিয়ে দাগ কাটা যায় এমন খনিজের কঠিনতা ১–২।
  • তামার মুদ্রা দিয়ে দাগ কাটা যায় যেগুলোতে, তাদের কঠিনতা প্রায় ৩।
  • ইস্পাত চাকু প্রয়োজন হয় যেগুলোতে, সেগুলোর কঠিনতা ৪–৫।
  • হীরার কঠিনতা সর্বোচ্চ ১০, যা সবচেয়ে কঠিন খনিজ।

৪। ভঙ্গুরতা (Fracture):
খনিজ ভাঙার ধরন থেকেও বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায়। এর মধ্যে শঙ্কাকৃতি, বাঁকানো ভঙ্গুরতা, সমভঙ্গুরতা, মেটে ভঙ্গুরতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৫। আপেক্ষিক গুরুত্ব (Specific Gravity):
খনিজ চেনার অন্যতম উপায় হলো এর আপেক্ষিক গুরুত্ব। এটি সাধারণত ১.৫ থেকে ২০.০ এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়। বেশিরভাগ খনিজের গুরুত্ব ২.০ থেকে ৪.০।

৬। বর্ণ (Colour):
বাহ্যিক বর্ণ দেখে অনেক সময় খনিজ চেনা যায়।

  • ম্যাগনেটাইট কালো,
  • চালকোপাইরাইট সোনালি-হলুদ,
  • গ্যালিনা সীসার মতো ধূসর।
    তবে অনেক সময় খনিজের মূল বর্ণ পরিবেশগত প্রভাব বা গঠনগত কারণে বদলে যেতে পারে।

৭। চূর্ণের বর্ণ (Streak):
খনিজকে চূর্ণ করলে তার আসল বর্ণ বোঝা যায়। এটিকে কর্মবর্ণ বলা হয়।

  • ম্যাগনেটাইট চূর্ণে কালো দাগ,
  • লিমোনাইট হলুদ দাগ,
  • হেমাটাইট বাদামী দাগ সৃষ্টি করে।
    সোনার বিশুদ্ধতা যাচাইয়েও এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

৮। দ্যুতি বা ঔজ্জ্বল্য (Lustre):
খনিজের উপরিভাগে আলো পড়লে যে উজ্জ্বলতা দেখা যায়, সেটিও শনাক্তকরণের অন্যতম উপায়।

  • পাইরাইট ধাতব উজ্জ্বল,
  • কোয়ার্টজ কাচের মতো,
  • স্ফেরিরাইট লাক্ষিক (varnish-like),
  • আঁশযুক্ত জিপসাম রেশমের মতো,
  • কিছু খনিজ হীরার মতো উজ্জ্বলতা প্রদর্শন করে।

খনিজ হলো প্রাকৃতিকভাবে গঠিত অজৈব পদার্থ, যার রয়েছে নির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য। বর্ণ, দ্যুতি, কঠিনতা, সম্ভেদ ও আপেক্ষিক গুরুত্বের মতো বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে খনিজকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। এগুলো শুধু ভূগোল ও ভূতত্ত্বেই নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও শিল্পক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৫। Chorley, R. J., & Haggett, P. (1971). Models in Geography. London: Methuen;
৬। Strahler, A. N. (1992). Physical Geography: Science and Systems of the Human Environment. New York: Wiley;


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


ওয়েগনারের মহাদেশ সঞ্চালন তত্ত্ব

কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি

দ্রাঘিমারেখার ব্যবহার: যে কোনো স্থান-দেশের সময়ের পার্থক্য নির্ণয়


Leave a Reply