খিলাফত ও খলিফা – এর ইতিকথা ও প্রকৃত মানে কি?
‘খলিফা’ ও ‘খিলাফত’ এই শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। তবে আমরা সবাই কি, এসব শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ সম্পর্কে জানি? হয়তো সবাই জানি না। এখানে, আমি আপনাদের কাছে ‘খলিফা’ ও ‘খিলাফত’ শব্দের সাথে জড়িত বিষয় ও ইতিকথা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। প্রথমে আমরা খিলাফত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
খিলাফত বলতে কি বুঝায়?
আরবি শব্দ ‘খিলাফা’ (خلافة khilafa) হতে ‘খিলাফত’ শব্দের উৎপত্তি। যার বাংলা অর্থ হলো উত্তরাধিকার। জানা যায় যে, খিলাফত হলো ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পরলোক গমনের পর প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্র এবং সরকার ব্যবস্থা, যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক একতার প্রতিনিধিত্ব করে। এবার, আমরা খলিফা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
খলিফা বলতে কি বুঝায়?
আরবি শব্দ ‘খালিফা’ (خلافة khalifa) হতে ‘খলিফা’ শব্দের উৎপত্তি। যার বাংলা অর্থ হলো প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী, কর্মাধ্যক্ষ, জনগণের দেখাশোনার দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ইসলামি পরিভাষায় খলিফা হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি যাবতীয় বিষয়ে শরিয়ত অনুযায়ী সকল উম্মতকে পরিচালিত করেন। ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা হলেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী, যিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর, শাসক, নেতা, বিচারকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের লোক নিযুক্ত করেন।
মুসলিম উম্মাহর প্রধান হিসেবে খলিফা হলেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নির্বাচিত উত্তরসূরি। তিনি হলেন বিশ্বাসীদের নেতা (বা আমীর-উল-মুমিনীন)। খলিফা কুরআন ও সুন্নাহ’র পবিত্র আইনকে কখনই রদ করতে পারেন না, তবে তিনি কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যাকারী, এবং তা কার্যকর করাই তাঁর মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য। এবার, আমরা খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো
খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
৬২২ সালে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, মনে করা হয় এর মাধ্যমে খিলাফতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর পরলোক গমনের পর সাহাবি আবু বকর (রা.) প্রথম ‘খলিফা’ নির্বাচিত হন, এবং ৬৩২ সালে রাশিদুন খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাশিদুন খিলাফত বলতে কি বুঝায়?
ইসলামের প্রথম চারজন খলিফাকে রাশিদুন বলা হয়। রাশিদুন খিলাফত হলো ইসলামের প্রথম খিলাফত, যা নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)’র পরলোক গমনের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই খিলাফতের সময় ছিল ৬৩২ থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত।
খুলাফায়ে রাশেদীন বলতে কি বুঝায়?
রাশিদুন খিলাফতের প্রথম চারজন খলিফাকে খুলাফায়ে রাশেদীন বলা হয়। আরবি ভাষায় এর অর্থ হলো ‘সঠিকভাবে পথ নির্দেশ প্রাপ্ত বা সঠিকভাবে জীবন-বিধান পালনকারী খলিফা (বা প্রতিনিধি)’।
ইসলামের খলিফার নাম কি?
ইসলামের প্রথম চারজন খলিফার নাম হলো: হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), এবং হযরত আলী (রাঃ)। এই চারজন খলিফাকে রাশিদুন খলিফা বলা হয়। সুন্নি মুসলমানরা এই চারজন খলিফাকে সবচেয়ে গুণী ও বিশুদ্ধ খলিফা বলে মনে করেন।
খিলাফত কবে শেষ হয়?
ইসলামের প্রধান চারজন খলিফার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত খিলাফতের স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ৩০ বছর। এরপরে সাহাবি মুয়াবিয়া কর্তৃক উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা হয়। উমাইয়াদের পতনের পরে ৭৫০ সালে দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর একটি প্রতিষ্ঠা করেন, আব্বাসীয়দের দ্বারা বাগদাদে (বর্তমান ইরাক), অপরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উমাইয়াদের দ্বারা স্পেনে।
১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের আক্রমণের ফলে খিলাফতের অন্যতম প্রধান রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয়ে যায় এবং খিলাফত বিলুপ্ত হয়ে যায়। মিশরের মামলুক শাসকদের দ্বারা পুনরায় আব্বাসীয় খিলাফত পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপর, ১৫১৭ সালে মিশরের আব্বাসীয় খলিফা কর্তৃক তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে খিলাফত হস্তান্তর করেন। ফলে ১৬ শতাব্দীতে উসমানীয় নামে নতুন একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুলতান প্রথম সেলিম হন উসমানীয় খিলাফতের প্রথম খলিফা। জানা যায় যে, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৯ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের মাধ্যমে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ অপসারিত হন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী এবং আরব বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদীদের হাতে উসমানীয় খিলাফত বিলুপ্তির মুখে পড়ে। ১৯২৪ সালে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে নির্বাসিত করে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফত বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
ভারত উপমহাদেশে কবে খিলাফত শাসন শুরু ও শেষ হয়?
জানা যায় যে, খিলাফতের শাসন আমলে খলিফার স্বীকৃতিবিহীন কোনো মুসলমান রাজ্যকে বিধিসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে বিবেচনা করা হতো না। আর এ কারণে দিল্লি ও বাংলার সুলতানগণ আব্বাসীয় খলিফার স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা করেছিলেন। ১৩-১৪ শতাব্দীতে সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (১২১১–১২৩৬), মুহম্মদ বিন তুগলক (১৩২৫-১৩৫১) এবং ফিরুজ শাহ তুগলক (১৩৫১-১৩৮৮) সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সনদপত্র লাভ করেছিলেন। আরও জানা যায়, মিশরের মামলুক শাসকের প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খলিফা বা মিশরের ফাতেমি খলিফাদের কাছ থেকে মুহম্মদ বিন তুগলক এবং ফিরুজ শাহ তুগলক সুলতান পদের সনদ পেয়েছিলেন।
বাংলায় কবে খিলাফত শাসন শুরু ও শেষ হয়?
বাংলার কোনো সুলতান কোনো খিলাফতের অধীন খলিফার স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন কিনা? তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে বাংলার সুলতানদের কেউ কেউ নিজ নিজ মুদ্রায় আব্বাসীয় খলিফাদের নাম উৎকীর্ণ করেছিলেন বলে জানা যায়। আবার, কেউ কেউ নাম উল্লেখ না করে খলিফার প্রতি আনুগত্য স্বীকারমূলক কথা তাঁদের মুদ্রায় উৎকীর্ণ করেন। আরও জানা যায় যে, পরবর্তীকালে ১৪ শতাব্দীতে বাংলা সালতানাতের দ্বিতীয় সুলতান সিকান্দর শাহ (১৩৫৮-১৩৯০) থেকে শুরু করে বাংলার কয়েকজন সুলতান নিজেরাই খলিফা উপাধি ধারণ করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা বাংলায় একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। [মো. শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
১। খিলাফত, wikipedia.org
২। খিলাফত, banglapedia.org