চেৎ-তা-গং – চেততৌগং – চিটাগং – চট্টগ্রাম নামকরণ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক বিভাগ ও জেলার নাম হলো চট্টগ্রাম। পাহাড়-পর্বত, টিলা, সমতল ভূমি, সমুদ্র সৈকত, নদী, খাল, প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় ভূমির সংমিশ্রণ গড়ে উঠা এ চট্টগ্রামের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এখানেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। তবে এ ‘চট্টগ্রাম’ নামকরণ কীভাবে করা হয়, জানেন কি? ‘চট্টগ্রাম’ নামকরণের রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্যও রয়েছে। তথাপি বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি ঐতিহাসিক ও জনশ্রুত তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো।

হিন্দু পৌরাণিক সূত্র মতে, এ অঞ্চলের (চট্টগ্রামের) নাম ‘আদর্শ দেশ’ (প্রগাদরর্শাৎ প্রত্যক্‌ কালকবনাৎ দক্ষিণেন হিমবন্ত মুত্তরেণ পরিপাত্রম)। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউ ইয়েন সাং, এ দেশ (চট্টগ্রাম)’কে ‘শ্রীচটল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তিব্বতের বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথ তাঁর একটি গ্রন্থে, চন্দ্রবংশের শাসনামলের রাজধানী চট্টগ্রাম ছিল বলে উল্লেখ করেন। এরূপ তথ্যের উল্লেখ আরাকানের সিথাং মন্দিরের শিলালিপিতেও রয়েছে বলে জানা যায়। তারানাথের গ্রন্থে, খ্রিস্টীয় দশম শতকের গোপীনাথ চন্দ্র নামের জনৈক রাজার কথা উল্লেখ রয়েছে (বাংলাপিডিয়া, খন্ড ৩, পৃ. ২৭৬)। আরও জানা যায়, সে সময় আরব দেশের বনিকগণ চট্টগ্রামে আগমন করতেন। আরব ভৌগোলিকদের বর্ণনায় ‘সমুন্দর’ নামক বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ‘সমুন্দর’ নামক বন্দরটি যে আসলে চট্টগ্রাম বন্দর তা নিয়ে এখন ঐতিহাসিকগণ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন (হাজার বছরের চট্টগ্রাম, পৃ. ‌২৩)।

পণ্ডিত বার্নোলির মতে, ‘শ্যাতগাঙ্গ’ শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। এখানে, আরবি ‘শ্যাত (খণ্ড)’ অর্থ বদ্বীপ, ‘গাঙ্গ’ অর্থ গঙ্গা নদী, যার অর্থ দাঁড়ায় গাঙ্গেয় বদ্বীপ

আরাকানি কাহিনিতে (arakanese chronicle) বর্ণিত ওয়েথালি (বৈশালি) রাজ্যের চন্দ্র পদবিধারী রাজবংশের নয়জন রাজা ৭৮৮ থেকে ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এ কাহিনিতে একজন রাজাকে চট্টগ্রাম বিজেতা হিসেবে উল্লেখ করা করেছে। জানা যায় যে, চন্দ্র রাজবংশের নবম রাজা সু-লা-তাইং-সান্দায়া বঙ্গ অভিযানে বের হন। রাজ্য বিজয়ের শেষের দিকে সু-লা-তাইং বিজিত রাজ্যের একটি স্থানে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এ স্তম্ভের গায়ে তিনি ‘চেৎ-তা-গং’ (tset-ta-gaung) কথাটি উৎকীর্ণ করান। ‘চেৎ-তা-গং’ এর অর্থ হলো ‘যুদ্ধ করা অন্যায়’। সে সময় থেকে স্থানটির নাম হয় ‘চেততৌগং’, যার পরিবর্তিত রূপ হলো ‘চিটাগং’ বলে জানা যায়।

আরও একটি তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, ৯৫৩ সালে সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া নামক আরাকানের চন্দ্রবংশীয় জনৈক রাজা চট্টগ্রাম অভিযানে আসেন। তিনি কোন এক অজ্ঞাত কারণে বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এটির গায়ে ‘চেৎ-ত-গৌঙ্গ’ লেখা হয়। যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। সে থেকে এ এলাকাটি ‘চৈত্তগৌং’ হয়ে যায় বলে আরাকানীয় পুথি ‘রাজাওয়াং’-এ লেখা হয়েছে। এ ‘চৈত্তগৌং’ থেকে কালের পরিক্রমায় চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চিটাগাং, চট্টগ্রাম, প্রভৃতি বানানের চল হয়েছে (হাজার বছরের চট্টগ্রাম, পৃ‌ ২৩)।

আরও জানা যায়, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে এ (বর্তমান চট্টগ্রাম) অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে বার জন আউলিয়া এসেছিলেন। তাঁরা বড় বড় বাতি বা চাটি জ্বালিয়ে উঁচু স্থানে বা সমুদ্র তীরবর্তী পাহাড়ে (বর্তমান কোর্ট হিল বা ফেয়ারি হিল) স্থাপন করেছিলেন। সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য বড় বাতি বা চাটি (light) জ্বালিয়ে রাখা হত। চাটির এ আলো সমুদ্রের বহু দূর থেকে দেখা যেত। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘চাটি’ শব্দের অর্থ বাতি বা চেরাগ এবং ‘গাঁও’ শব্দের অর্থ গ্রাম। আর এ থেকে নামকরণ হয় ‘চাটিগাঁও’।

১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন মরক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন –‘বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমুদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেগুলো দিয়ে তারা লখনৌতির লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।…আমি সোদকাওয়াঙ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম।’ এখানে, ইবনে বতুতার বর্ণনায় চট্টগ্রামের আরেকটি প্রাচীন নাম ‘সোদকাওয়াঙ’ পাওয়া যায়। কেউ কেউ ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম সাদ কাওয়ান উল্লেখ করেন।

এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্সের বর্ণনা মতে, এ এলাকাটির ছোট্ট একটি পাখির নাম থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।

চট্টগ্রামের মুসলমান শাসক নুসরাত শাহ, চট্টগ্রামের উত্তরাংশ অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর তীর পর্যন্ত জয় লাভ করে এবং এ স্থানের (বর্তমান চট্টগ্রাম) নাম দেন ‘ফতেয়াবাদ’

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনাধীন হয়। আরাকানীদের বিতাড়িত করে মুঘল শাসনামলে মুঘল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খান এ এলাকার (বর্তমান চট্টগ্রামের) নাম রাখেন ‘ইসলামাবাদ’। ঐ সময় মুঘলের প্রশাসনিক সীমানা চিহ্নিত করা হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে নবাব মীর কাশিম আলী খান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এটি হস্তান্তর করেন। ব্রিটিশরা এর নাম রাখেন ‘চিটাগাং’

প্রাচীনকালে চট্টগ্রামে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ চৈত্য’র অবস্থান ছিল বলে জানা যায়। বহুসংখ্যক বৌদ্ধ চৈত্য’র অবস্থানের কারণে প্রাচীনকালে এ জায়গা ‘চৈত্যগ্রাম’ হিসেবে পরিচিত ছিল। সে চৈত্য থেকে চৈত্যগ্রাম হয়ে এ স্থানের নাম তদপভ্রংশে চট্টগ্রাম হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

ইংরেজ ভ্রমণকারী Ralph Fitch, এ দেশ (চট্টগ্রাম)’কে ‘রামেশ’ বলে উল্লেখ করেছেন। ব্রিটিশ সামরিক অফিসার কর্নেল উইলফোর্ড এ এলাকার (চট্টগ্রামের) নাম ‘পুস্পপুর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন (চট্টগ্রাম শহরের পশ্চিমে ‘কর্নেল হাট’ তাঁর স্মৃতি বহন করে)।

ব্রাহ্ম ভাষায় এ স্থান (চট্টগ্রাম)’কে ‘চিতাঁগাও’ বলা হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘চিতাঁগাও’ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি হয়েছে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রাচীন নাম: (১) আদর্শ দেশ বা আদর্শ গ্রাম, (২) সুহ্মদেশ, (৩) ক্লিঙ্ক বা কালেন, (৪) রম্য ভূমি, (৫) চিতাগাঁও, (৬) চটতল, (৭) চৈত্যগ্রাম, (৮) সপ্তগ্রাম, (৯) চট্টলা, (১০) চট্টগ্রাম, (১১) চক্রশালা, (১২) চন্দ্রনাথ, (১৩) চরতল, (১৪) চিতাগঞ্জ, (১৫) চাটিগাঁ (১৬) শ্রী চট্টল (১৭) সাতগাঁও (১৮) সীতাগং, (১৯) সাদ কাওয়ান, (২০) পুস্পপুর, (২১) সহরেসবুজ, (২২) পার্বতী, (২৩) খোর্দ –আবেদ (২৫) পোর্ট গ্রান্ডো (বৃহৎ বন্দর), (২৬) ফতেয়াবাদ, (২৭) রোশাং, (২৮) ইসলামাবাদ, (২৯) চিটাগাং বা Chittagong। (সুত্র: চট্টগ্রামের ইতিহাস, প্রনেতা চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেব্বর্ম্মা তত্ত্বনিধি)।’ [মো: শাহীন আলম]


তথ্যসূত্র:
১। কানুনগো, সুনীতিভূষণ, ২০২১, চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস, ঢাকা: বাতিঘর, পৃষ্ঠা – ২৮।
২। জেলার ইতিহাস, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ওয়েব পোর্টাল
৩। চট্টগ্রাম জেলা, (wikipedia)
৪। Chowdhury, Quamrul, চট্টগ্রামকে কেন চট্টগ্রাম নামে নামকরণ করেছে? Quora


চট্টগ্রাম নামকরণ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


Follow Us in Our Youtube Channel: GEONATCUL


Leave a Reply