আজকের বাংলাদেশ নামটি চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন বাঙ্গালা নাম থেকে সৃষ্টি !
বাঙ্গালী জাতির আদি বাসস্থান ছিল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। বাঙ জাতির উদ্ভবের সময় সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবে মনে করা হয়, ৪ হাজার বছর আগে থেকে বাঙ জাতি বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে বাস করত। এ জাতিটিকে নিয়ে বাঙ নামের প্রাচীন (ancient) জনপদ গড়ে উঠে। বর্তমানের বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, খুলনার পূর্বাংশ ও ফরিদপুরের দক্ষিণাংশ নিয়ে প্রাচীন বাঙ বা বঙ্গ জনপদ গড়ে উঠে ছিল। বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ – ৬০০ অব্দ) এ অঞ্চলটি বাঙ্গাল নামে পরিচিত ছিল।
জানা যায় যে, বাঙ জাতি লবনাক্ত ও বন্যার পানি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল বা বাঁধ নির্মাণ করতেন। আর বাঙ শব্দের সাথে ‘আল’ যুক্ত হয়ে বাঙাল হয়। আরো জানা যায়, বাঙ জাতি কোটালীপাড়া, ফুলশ্রী, বারথী, শোলক, শিকারপুর, রামসিদ্ধি, জয়শ্রী, ইদিলপুর, মাহিলারা প্রভৃতি এলাকায় সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তোলে। আর এ এলাকাগুলোর ঐক্যবদ্ধ নাম ছিল বাঙ্গালা।
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতক থেকে বঙ্গ জনপদে চন্দ্র রাজবংশের প্রাধান্য লাভ করে। এ রাজবংশের নামানুসারে বঙ্গ জনপদের নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। চন্দ্রদ্বীপ নামটি রাজনৈতিকভাবে প্রাধ্যন্য পেলেও বাঙ্গালা নামটি বহু শতাব্দী ধরে টিকে থাকে। রাজা শ্রীচন্দ্রের তাম্রলিপিতে বাঙালা ও বিশ্বরূপ সেনের মধ্যপাড়া তাম্রশাসনে বাঙ্গালাবাদ নামের উল্লেখ রয়েছে। বাঙ্গালা নামে বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার রামসিদ্ধি গ্রামের পাশে একটি গ্রাম রয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. আর. সি. মজুমদার গৌরনদীর বাঙ্গালা গ্রাম ও বাঙ্গালাবাদকে অভিন্ন বলেছেন।
বরিশাল বিভাগে নির্মিত চৌচালা ঘরকে ‘বাংলা ঘর’ এবং ব্যবহৃত ‘দা’কে ‘বাংলা দা’ বলা হয়। প্রাচীন বাঙ্গালাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে উচ্চারণ করা হয়েছে। বিদেশী পর্যটকগণ বাঙ্গালাকে পাংকোলা, বারাকোরা, বাটিকোলা, বাঙ্গালা ও বাকোলা নামে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ বরিশাল বিভাগের জনগণকে আজও বাঙ্গাল বলে সম্বোধন করে থাকে। সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর জনগণ বরিশালের অধিবাসীদের বাকলার পরিবর্তে বাকলাইয়া বলে থাকে। কালের চক্রে বাঙ্গালা নামটির উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে বাকলা হয়েছে। বাকলা ও চন্দ্রদ্বীপ উভয়ই বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন নাম। বাঙ জাতির বাংলা ভাষার আদি কবি মীননাথের জন্ম প্রাচীন বাকলায়। বরিশাল অঞ্চলের অধিবাসীদের মুখে বাংলা ভাষার সাধু রূপ বেশি দেখা যায়।
বাঙ্গালা নামটির প্রাচীন ঐতিহ্য কেবল বরিশাল বিভাগেই দেখা যায়। বাংলাদেশের অন্য কোন জেলা কিংবা বিভাগে বাঙ্গালা নামের কোন ঐতিহ্য কিংবা স্থান দেখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে আজকের বাংলাদেশ নামটি চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন বাঙ্গালা নাম থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। পাল ও সেন বংশের শাসনামলে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী জাতির ব্যাপক সমন্বয় ও বিকাশ সাধিত হয়েছে। সমন্বিত ও বিকশিত এ বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী জাতি বাকলা-চন্দ্রদীপ বা বরিশাল থেকে উদ্ভব হয়েছিল। তাইতো ইতিহাসবিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ উল্লেখ করেছেন, ‘বাঙ্গালী জাতি গঠনের ঊষালগ্নে বরিশাল বিভাগের এ অবদান বাংলার ইতিহাসের আকাশে নক্ষত্রের মত চিরকাল জ্বলজ্বল করবে।’ [মো. শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
আহমেদ, সিরাজ উদ্দীন, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ২০০৩, ভাস্কর প্রকাশনী, বরিশাল-ঢাকা, পৃষ্ঠা ৪৯ – ৭৫।
বাংলাদেশ নামটি চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন বাঙ্গালা নাম থেকে সৃষ্টি
Follow Us on Our YouTube Channel: GEONATCUL