কুমিল্লার জগন্নাথ দিঘী: জলাশয় ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন
জলাশয় ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত জগন্নাথ দিঘী। বিশাল আকৃতির এ জলাশয়টি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত চিওড়া বাজার হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে লাগোয়া পূর্ব পাশে অবস্থিত।
আয়তাকার দিঘীটি প্রায় ৫৩ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। পাড়সহ দিঘীটির পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৮০০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১২৫০ ফুট। দিঘীটি হতে প্রায় আধা (৫০০ মিটার) কিলোমিটার পূর্ব দিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অবস্থিত।
জগন্নাথ দিঘী নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি এবং ইতিকথা প্রচলিত রয়েছে। জানা যায় যে, প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে জগন্নাথ নামক জনৈক স্থানীয় জমিদার এ এলাকার জনগণের পানীয় জলের সংকট নিবারণে বিশাল আকারের এ দিঘী খনন করেন। দিঘীটি স্থানীয়ভাবে পরীর দিঘী নামেও সুপরিচিত।
আরও জানা যায় যে, জগন্নাথ দিঘী বাংলাদেশের কুমিল্লায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দিঘী। বিশিষ্ট লেখক জহির রায়হান তাঁর ‘হাজার বছর ধরে’ নামক উপন্যাসে জগন্নাথ দিঘীর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এর নাম পরীর দিঘী বলে উল্লেখ করেন। জহির রায়হান তার উপন্যাসে, এটি পরীরা খনন করেছে, উল্লেখ করেন। আর এ দিঘীর নামানুসারে এখানকার প্রশাসনিক ইউনিয়নের নামকরণ হয় জগন্নাথ দিঘী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জগন্নাথ দীঘির পাড়ে পাক বাহিনী সেনা ঘাঁটি স্থাপন করে, যা ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর শেষ রাতে পতন ঘটে বলে জানা যায়। এ সেনা ঘাঁটির পতনের মধ্য দিয়ে কুমিল্লা জেলার জগন্নাথ দিঘী এলাকার উত্তর-দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার শত্রুমুক্ত হয়। পরদিন, ২৮ নভেম্বর, সকালে সকল মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতায় দিঘী পাড়ের পাক বাহিনীর ঘাঁটিতে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন ত্রিপুরা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প জগন্নাথ দিঘীর পূর্বপাড়ে তৈরী হয় বলে জানা যায়। ২৮ নভেম্বর হলো জগন্নাথ দিঘী মুক্ত দিবস। কুমিল্লার, তথা দেশের পূর্বাঞ্চলের প্রথম শত্রুমুক্ত এলাকা, এ জগন্নাথ দিঘী বলে জানা যায়।
আরও জানা যায় যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের (শাসনকাল: ১৯২৩-১৯৪৭) খুবই প্রিয় ছিল কুমিল্লার এ চৌদ্দগ্রাম এলাকা। এ এলাকা হতে ত্রিপুরার রাজার রাজ কোষাগারে প্রচুর রাজস্ব আয় জমা হতো বলে জানা যায়। মানবিক এ মহারাজা এ এলাকায় বহু জনকল্যাণকর কাজও করেছেন। চৌদ্দগ্রামে অবস্থিত বড় বড় জলাশয়, বিশেষ করে জগন্নাথ দিঘীসহ অন্যান্য জলাশয়গুলো তারই পরিচয় বহন করে।
জগন্নাথ দিঘীর সৌন্দর্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কপথে যাতায়াতকালে বহু পথিককে আকর্ষণ করে। আর কারণেই এ মহাসড়কপথে যাতায়াতকালে পথিকগণ এ দিঘীর পাড়ে সাময়িক যাত্রা বিরতি করে। বর্তমানে এ দিঘীটির পশ্চিম পাড়ে মহাসড়কের পাশে ছোট ছোট কিছু খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। বিশ্বায়নের এ যুগে আধুনিক উন্নয়ন কাজের প্রভাবে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান ও নিদর্শন আজ ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী জলাশয় জগন্নাথ দিঘীটিকে কেন্দ্র করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কুমিল্লা জেলায় একটি পর্যটন স্থান গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। আর এ লক্ষ্যে, জগন্নাথ দিঘীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ পরিকল্পনা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। [মো. শাহীন আলম]
Sources:
১। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পটভূমি;
২। Dipanjan Das | Save the Heritages of Bangladesh;
৩। জগন্নাথদীঘি ইউনিয়ন, wikipedia.org.
জগন্নাথ দিঘী আয়তন