জোয়ার-ভাঁটা এবং এর কারণ
সাধারণত সমুদ্র পানির ফুলে উঠাকে জোয়ার (high tide) এবং নেমে যাওয়াকে ভাঁটা (low tide) বলে। অর্থাৎ সমুদ্রের পানি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে দুই বার এক স্থানে ফুলে উঠে এবং অন্য স্থানে নেমে যায়। সমুদ্র পানির এ ফুলে উঠাকে জোয়ার এবং নেমে যাওয়াকে ভাঁটা বলা হয়। আমরা জানি, সমুদ্রের পানি প্রতিদিন ১২.৫ ঘন্টায় একবার নিয়মিতভাবে উঠানামা করে। সমুদ্রের মোহনা থেকে নদীগুলোর প্রবাহপথের কয়েক কিলোমিটার উজানের (upstream) দিকে জোয়ার ভাঁটা অনুভূত হয়। গভীর সমুদ্র এবং সমুদ্রের মধ্যভাগের চেয়ে উপকূলের কাছে পানির অগভীর অংশে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
পৃথিবীর মোট পানির পরিমাণ সব স্থানে সমান। যখন পৃথিবীর কোনো একটি স্থানে মুখ্য জোয়ার ও তার বিপরীত স্থানে গৌণ জোয়ার। তখন ঐ স্থানের মধ্যবর্তী সমকোণে অবস্থিত দুইটি স্থান থেকে পানি মুখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ার স্থানের দিকে প্রবাহিত হওয়ায় সেখানে পানি কমে যায়। ফলে পানির পৃষ্ঠদেশের উচ্চতা কমে যাওয়ার অবস্থাকে ভাঁটা বলে। আর পৃথিবীর একটি স্থানে প্রতিদিন দুই বার ভাঁটা সংগঠিত হয়। জোয়ার ও ভাঁটা প্রত্যেকের স্থিতিকাল প্রায় ৬ ঘন্টা।
জোয়ার-ভাঁটার কারণ: প্রাচীনকালে গ্রীক মনীষীগণ মনে করতেন, পৃথিবীর শ্বাস প্রশ্বাসের কারণে জোয়ার ভাঁটা সংগঠিত হয়। পৃথিবী যখন শ্বাস গ্রহণ করে, তখন সমুদ্রের পানি ফুলে উঠে; ফলে জোয়ার সংগঠিত হয়। এবং পৃথিবী যখন শ্বাস ত্যাগ করে, তখন সমুদ্রের পানি নেমে যায়, ফলে ভাঁটা সংগঠিত হয়। পরবর্তীকালে জোয়ার ভাঁটা সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর শ্বাস প্রশ্বাসের ধারণা পরিবর্তন হয়। বর্তমানে বিজ্ঞাণীগণ মনে করেন, চাঁদ এবং সূর্যের আকর্ষণের ফলে সমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটা সংগঠিত হয়। নিম্নে জোয়ার ও ভাঁটার কারণসমূহ তুলে ধরা হলো:
ক) মহাকর্ষণ শক্তির প্রভাব (effect of gravity): মহাবিশ্বে নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহসহ সব পদার্থই পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এ আকর্ষণের নাম হল মহাকর্ষণ। এ মহাকর্ষণ শক্তির কারণে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে এবং চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে পরিভ্রমণ করছে। এ আকর্ষণের জন্য পৃথিবী পৃষ্ঠের পানি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। তবে এ মহাকর্ষণ শক্তির পরিমাণ সব স্থানে সমান নয়। যে নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহ যত বড়, তার আকর্ষণ করার ক্ষমতাও তত বেশি।
তবে দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহসমূহের মধ্যকার আকর্ষণ করার ক্ষমতাও কমে যায়। সূর্য (নক্ষত্র) ও চাঁদ (উপগ্রহ) উভয়েই পৃথিবীকে আকর্ষণ করছে। চাঁদের চেয়ে সূর্য অনেক বেশি বড়। তবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব চাঁদের চেয়ে অনেক বেশি। আর এ কারণে পৃথিবীর উপর সূর্যের আকর্ষণের চেয়ে চাঁদের আকর্ষণ অনেক বেশি কার্যকরী। পৃথিবী এবং এর পদার্থসমূহের উপরে সূর্যের চেয়ে চাঁদের আকর্ষণের কার্যকরী শক্তি প্রায় দ্বিগুণ। সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর স্থলভাগের কেন্দ্র ভূমির কাছে কাজ করে। তবে পানি তরল বলে এর উপরিভাগে আকর্ষণ শক্তি বেশি কার্যকরী হয়।
অর্থাৎ পানির উপরই সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ শক্তির প্রভাব অনুভূত হয়। সুতরাং পৃথিবীর কেন্দ্র এবং পানির উপরিভাগের উপর সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ শক্তির তারতম্য জোয়ার-ভাঁটার কারণ। এছাড়া পৃথিবী ও চাঁদের আবর্তনের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের তরল ও হালকা পদার্থগুলোর উপর বিকর্ষণ শক্তির প্রভাব বেশি হয়। এ বিকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই পানি সব সময় বাহিরের দিকে বিক্ষিপ্ত হয় এবং কঠিন ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। এটিই জোয়ার ভাঁটায় সহায়তা করছে।

খ) বিকর্ষণ শক্তির (centrifugal force) প্রভাব: মোটর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বা অন্য কোনো যানবাহন যখন দ্রুত বেগে ছুটে চলে, তখন এসব যানবাহনের চাকা থেকে কাঁদা দ্রুত বেগে নিক্ষিপ্ত হয়। এরূপভাবে পৃথিবীর মেরু রেখা বা অক্ষের চারদিকে দ্রুত ঘুরছে বলে এর পৃষ্ঠ থেকে পানি বিপরীত দিকে দ্রুত বেগ যেতে চায়। আর একে বিকর্ষণ শক্তি বলে। এ বিকর্ষণ শক্তি জোয়ার ভাঁটা সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। [মো: শাহীন আলম]
✅ জোয়ার-ভাঁটা কাকে বলে? জোয়ার-ভাঁটার কারণের বিবরণ।
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL