ত্রিপুরার বক্সনগর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ | সিপাহীজলা
বক্সনগর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ভারতের পূর্বাঞ্জলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় অবস্থিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। কে বা কারা এবং কোন সময়ে এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের স্থাপত্যিক নিদর্শনগুলো নির্মাণ করেছে, তা জানা যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে উন্মোচিত প্রত্ন-স্থাপত্যিক নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নবস্তুর প্রমাণ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেন যে, বক্সনগরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন। যা আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিকশিত হয়ে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সে সময়ে বৌদ্ধ সভ্যতার এ কেন্দ্রটি সম্ভবত বৌদ্ধধর্ম প্রসারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
প্রত্ন-স্থাপত্যিক নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নবস্তুর প্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় যে, ত্রিপুরার বক্সনগর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো বাংলাদেশের কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতিতে আবিষ্কৃত শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার, কোটিলা মুড়া, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সমসাময়িক (?)।
ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বক্সনগরে পোড়ামাটির ইট দিয়ে নির্মিত একাধিক স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষে উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে – স্তূপের একটি ধ্বংসাবশেষ, যা চৈত্যগৃহ বা গুহা মন্দির হিসেবে সুপরিচিত; মন্দিরের একটি ধ্বংসাবশেষ এবং বিহারের বা সন্ন্যাস আশ্রমের একটি ধ্বংসাবশেষ এখানকার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। এসব ধ্বংসাবশেষগুলো বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্কিত বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে।

এখানে আবিষ্কৃত বর্গাকার স্তূপটির প্রতিটি বাহুর পরিমাপ ১৫.৪০ মিটার। স্তুপটির স্থাপত্য পরিকল্পনায় পঞ্চ রথের (pancharatha) প্রতিফলন দেখা যায়। স্তূপের পূর্ব অংশে চৈত্যগৃহ (shrine) অবস্থিত। খননকালে আয়তাকার এ চৈত্যগৃহের ধ্বংসাবশেষ প্রকাশ্যে আসে, যা পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। বিভিন্ন আকারের পোড়ামাটির ইট ও চুন-বালির সংমিশ্রণ দিয়ে এ স্তুপটি নির্মাণ করা হয়েছে।

বর্গাকার স্তূপটি থেকে প্রায় ৩০ মিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আয়তাকার অপর একটি স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে। ৩০ মিটার দীর্ঘ এবং ১৮ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট এ কাঠামো মূলত ছোট আকারের একটি বিহারের (monastery) ধ্বংসাবশেষ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এটির উত্তরাংশে পাঁচটি এবং দক্ষিণাংশে পাঁচটিসহ সর্বমোট দশটি কক্ষ এবং মাঝখানে সরু গলি (পথ) দেখা যায়, যা পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। এটির নির্মাণ কাজেও বিভিন্ন আকারের পোড়ামাটির ইট ও চুন-বালির সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে।

বিহারটি থেকে প্রায় ২৫ মিটার উত্তর-পূর্ব কোণে এবং বর্গাকার স্তূপ থেকে প্রায় ৬৫ মিটার পূর্ব দিকে আরেকটি স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে। ২৩.৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ১৫.৫০ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট আয়তাকার এ কাঠামোটি মূলত একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মন্দিরটির কেন্দ্রে একটি গর্ভগৃহ এবং সামনে প্রবেশপথ কমপ্লেক্স রয়েছে, যা পশ্চিম দিকে প্রক্ষিপ্ত। এটির নির্মাণ কাজেও বিভিন্ন আকারের পোড়ামাটির ইট ও চুন-বালির সংমিশ্রণ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
পরিদর্শনকালে জানা যায় যে, এখানে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য প্রত্নবস্তুসমূহের মধ্যে রয়েছে – বুদ্ধের তিনটি তামার মূর্তি, বিশেষ আকৃতির ইট, ঈশ্বরীকৃত স্তূপ, সিলমোহর এবং রৌপ্য মুদ্রা, ইত্যাদি। ১৯৮৮ সালে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ এ স্থানটির সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বক্সনগর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ নামক এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির অবস্থান ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যতম জেলা সিপাহীজলায়। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে সড়কপথে ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে বিশালগড় মহকুমার বক্সনগর নামক ব্লকে এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি অবস্থিত। সড়কপথে মিনিবাস, মাইক্রোবাস, অটো, মোটরসাইকেল, প্রভৃতি পরিবহণযোগে সহজে এ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটিতে গমন করা যায়। [মো. শাহীন আলম]
তথ্যসূত্র:
১। অধীক্ষক প্রত্নতত্ত্ববিদ, ভারতীয় প্রত্নতত্ব জরিপ বিভাগ, আইজল মন্ডল;
২। ত্রিপুরার বক্সনগর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ সরেজমিন পরিদর্শন।
ত্রিপুরার বক্সনগর প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ
Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL