পাঁচথুবী মন্তের মুড়া: লালমাই ময়নামতি-গ্রুপ-অব-মনুমেন্ট সংলগ্ন সমতল ভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান

পাঁচথুবী মন্তের মুড়া
পাঁচথুবী মন্তের মুড়ায় উন্মোচিত স্থাপত্যিক কাঠামো

বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলাধীন আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের ইটল্লা গ্রামে মন্তের মুড়া নামক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান অবস্থিত। কুমিল্লা জেলা শহরের কেন্দ্র থেকে আঁকাবাঁকা সড়কপথে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তর দিকে মুন্সির বাজার। এ বাজার থেকে প্রায় দুই শত ত্রিশ মিটার পূর্ব দিকে ইটল্লা গ্রামে মন্তের মুড়া প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবিটির অবস্থান।

বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানের ফলে মন্তের মুড়া প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে বিভিন্ন ধরনের প্রত্নস্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়েছে। উন্মোচিত স্থাপত্য কাঠামো ও স্তরায়নের উপর ভিত্তি করে আনুমানিক চারটি কালপর্ব শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হল –
প্রথম কালপর্ব: প্রথম বসতি স্থাপন ও স্থাপত্য নির্মাণ;
দ্বিতীয় কালপর্ব: স্থাপত্য নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও পরিবর্ধন;
তৃতীয় কালপর্ব: সম্প্রসারণ, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন; এবং
চতুর্থ কালপর্ব: পরিত্যক্ত, পুনর্বসতি স্থাপন ও স্থাপত্য নির্মাণ।

এছাড়া, মন্তের মুড়া প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে খননকালে পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির তৈজসপত্র, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক নিদর্শন বিভিন্ন ধরনের প্রতিমার অংশবিশেষসহ প্রভৃতি প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়।

প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ, তথ্য-উপাত্ত ও রেকর্ড পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে এবং মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে পাঁচথুবী নামক একটি প্রাচীন গ্রামে কিছু কাল আগে পর্যন্ত পাঁচটি ঢিবি বা স্তূপের অস্তিত্ব ছিল। কাছাকাছি অবস্থানরত ঢিবিগুলিতে প্রচুর প্রাচীন ইট ছিল। এই পাঁচটি ঢিবি বা স্তূপের অস্তিত্ব থেকেই এ গ্রামের নাম হয়েছিল পরবর্তীকালে পাঁচথুবী। যা পাঁচ স্তূপী পাঁচস্তূপ পঞ্চস্তূপ বিবর্তিত রূপ)। খুব সম্ভব এগুলি ছিল বৌদ্ধস্তূপ। বর্তমান কালে স্তূপগুলির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ স্থানে আরও অনেক প্রাচীন ইমারতাদির ধ্বংসাবশেষ ছিল। সেগুলির মধ্যে একটি চকমিলান ইমারতকে এক মহারাজার বাড়ি বলে চিহ্নিত করা হয়। খুব সম্ভব এটি ছিল দুর্গাকারে নির্মিত একটি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। এটিসহ এস্থানের আরও অনেক কীর্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাটির নিচে প্রচুর প্রাচীন ইট ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া যায়। খুব সম্ভব এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল।

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, মন্তের মুড়া হল কথিত মহন্ত রাজার বাড়ি। এ মহন্ত রাজা’কে বা কখন তিনি রাজত্ব করেছেন এ সম্পর্কিত কোন তথ্য প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি।

আরএস-এ রের্কড অনুযায়ী মন্তের মুড়া প্রত্নস্থানটি নরসিংহ বিগ্রহ মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি। নরসিংহ হল বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। পুরাণ, ও অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে তার উল্লেখ রয়েছে। এ তথ্য অনুসারে এ প্রত্নস্থানটি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির কোন কেন্দ্র হতে পারে (?)

মন্তের মুড়া প্রত্নস্থানটি বর্তমানে ইটল্লা নামক গ্রামে অবস্থিত। খুব সম্ভবত ইটবিশিষ্ট উঁচু ঢিবির অস্তিত্বের কারণে কিংবা মাটি খুড়লে বড় বড় প্রচুর ইট খুঁজে পাওয়া যেতো বলে এ গ্রামের নামকরণ ইটল্লা হয়ে থাকতে পারে।

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, মন্তের মুড়া হল কথিত মহন্ত রাজার বাড়ি। খুব সম্ভবত এ ‘মহন্ত’ নামটির সংকোচিত রূপ ‘মন্ত’ হয়েছে। মুড়া’র আভিধানিক অর্থ হল অগ্রভাগ বা প্রান্ত। আর স্থানীয়ভাবে উঁচু স্থানকে বুঝাতে ‘মুড়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সুতরাং মন্ত, এর, এবং মুড়া মিলে বর্তমানে ‘মন্তের মুড়া’ নামকরণ করা হয়েছে। যাহোক, পাঁচথুবী মন্তের মুড়া প্রত্নস্থানটি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধানের ফলে কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি-গ্রুপ-অব-মনুমেন্ট সংলগ্ন সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম উন্মোচিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান বলা যেতে পারে। [মো: শাহীন আলম]


সহায়ক গ্রন্থাবলী
১। আহমেদ, ডক্টর নাজিমুদ্দিন, মহাস্থান ময়নামতি পাহাড়পুর, ১৯৭৯, প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগ, ঢাকা।
২। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা কুমিল্লা, ২০১৭, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৩। যাকারিয়া, আবুল কালাম মোহাম্মদ, বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, ২০১০, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা।
৪। কাসেম, আবুল, কুমিল্লার ইতিহাস আদি পর্ব, ২০০৮, গতিধারা, ঢাকা।
৫। যাকারিয়া, আবুল কালাম মোহাম্মদ, কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, ১৯৮৪, জেলা পরিষদ, কুমিল্লা।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার: প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ, কুমিল্লা।


Follow Us in Our YouTube channel: GEONATCUL



Leave a Reply