পুঠিয়া রাজবাড়ির পুরাকীর্তি | রাজশাহী

পুঠিয়া রাজবাড়ির পুরাকীর্তি | রাজশাহী

বাংলাদেশে রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলাধীন পুঠিয়া উপজেলা সদরের কৃষ্ণপুর গ্রামে পুঠিয়া রাজবাড়ির পুরাকীর্তিসমূহ অবস্থিত। পুঠিয়া রাজবাড়ি স্থানীয়দের কাছে পাঁচআনি জমিদারবাড়ি নামে পরিচিত। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া রাজবাড়ির ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক বা জিও কো-অর্ডিনেট (অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ) হল 24°21’42.8″N 88°50’11.9″E (24.361900, 88.836647)

আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মিত পুঠিয়া রাজবাড়িটিতে প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনাগুলো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে এখনও টিকে আছে। পুঠিয়া রাজবাড়ির মন্দিরগুলো শ্যাম সরোবর নামে একটি আয়তাকার হ্রদের চারপাশের একটি জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এ জমিটি গোবিন্দ সরোবর নামক একটি রৈখিক হ্রদ দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছে। পুঠিয়া রাজবাড়িতে টিকে থাকা উল্লেখযোগ্য কতিপয় মন্দির স্থাপত্যিক পুরাকীর্তির বর্ণনা নিম্নে তুলে ধরা হলো।

বড় শিব মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল বড় শিব মন্দির। পুঠিয়া বড় শিব মন্দির নামে পরিচিত এ মন্দিরটি পঞ্চরত্ন ধরনের স্থাপত্য। বর্গাকার পরিকল্পনায় নির্মিত এ স্থাপনার প্রতিটি বাহুর পরিমাপ ১৪.৪৭ মিটার। মন্দিরটি ক্ষুদ্র চার চালা ভল্ট (four roofs vaults) আকারে নির্মাণ করা হয়েছে। দুই তলাবিশিষ্ট এ মন্দিরটির ছাদে ৫টি শিখর (spires) রয়েছে। প্রবেশপথগুলোতে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। মন্দিরটির উচ্চতা ১৮.২৮ মিটার। মন্দিরের অভ্যন্তরের এবং বাহিরের দেয়াল জুড়ে হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন চিত্রিত স্টাকো (stucco) অলঙ্করণ রয়েছে।

 

ছোট শিব মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির আরেকটি পুরাকীর্তি হল ছোট শিব মন্দির। পুঠিয়া ছোট শিব মন্দির নামে পরিচিত এ মন্দিরটি বর্গাকার পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। চার চালাবিশিষ্ট ভল্ট (vault) আকারে নির্মিত এ মন্দির স্থাপত্যের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৪.১৭ মিটার। মন্দিরটির সামনের দেয়ালে ১টি প্রবেশপথ রয়েছে। এ মন্দিরটির প্রবেশপথে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। এ মন্দিরটির দেয়াল জুড়েও রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন চিত্রিত পোড়ামাটির অলঙ্করণ রয়েছে।

রথ মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির অন্যতম উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি হল রথ মন্দির। পুঠিয়া রথ মন্দির নামে পরিচিত স্থাপত্যটি হল একটি অষ্টভুজাকার ছত্রী বা কিয়স্কের (kiosk) উপরে একটি অষ্টভুজাকার খিলানযুক্ত গম্বুজসহ নির্মিত কাঠামো। মন্দিরের অষ্টভুজের প্রতিটি বাহু ৪.৯০ মিটার। অষ্টভুজাকার পরিকল্পনার দুই তলাবিশিষ্ট এ মন্দিরটির প্রবেশপথগুলোতে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। মন্দিরটির অভ্যন্তরের এবং বাহিরের দেয়াল জুড়ে হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন চিত্রিত স্টাকো (stucco) অলঙ্করণ রয়েছে।

 

দোল মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির আরেকটি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি হল দোল মন্দির। পুঠিয়া দোলমঞ্চ নামে পরিচিত এ মন্দিরটি বর্গাকার পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরটির প্রতিটি পাশের পরিমাপ ২১.৩৩ মিটার। এ মন্দিরটি  চার তলাবিশিষ্ট স্থাপনা, যা ধীরে ধীরে পিরামিডের মত করে ক্রমে সরু হয়ে ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়েছে। প্রতিটি তলায় কলোনেড (colonnade) বারান্দা রয়েছে। এর সবচেয়ে উপরের তলাটি একটি ছোট গম্বুজ (cupola) দিয়ে আবৃত। মন্দিরটির প্রবেশপথগুলোতে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়।

 

বড় গোবিন্দ মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি হল বড় গোবিন্দ মন্দির। পুঠিয়া বড় গোবিন্দ মন্দিরটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পঞ্চরত্ন ধরনের স্থাপত্য মনে করা হয়। এ মন্দিরটি  বর্গাকার পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। এর প্রতিটি রত্ন (চূড়া) চার চালা দিয়ে আবৃত, প্রতিটি বাহির দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। মন্দিরটির প্রবেশপথগুলোতে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। মন্দিরের দেয়াল জুড়ে রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন  চিত্রিত পোড়ামাটির অলঙ্করণ রয়েছে।

ছোট গোবিন্দ মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির অন্যতম পুরাকীর্তি হল ছোট গোবিন্দ মন্দির। পুঠিয়ার ছোট গোবিন্দ মন্দিরটি বর্গাকার পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। চার চালা ধরনের স্থাপত্যটির প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৭.৭৪ মিটার। মন্দিরটির সামনের দেয়ালে তিনটি এবং পূর্ব ও পশ্চিমে একটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। এ মন্দিরটির প্রবেশপথগুলোতে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। এ মন্দিরটির দেয়াল জুড়েও রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন চিত্রিত পোড়ামাটির অলঙ্করণ রয়েছে।

বড় আহ্নিক মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির আরেকটি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি হল বড় আহ্নিক মন্দির। পুঠিয়া বড় আহ্নিক মন্দির নামে পরিচিত এ মন্দিরটি আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। এ মন্দির স্থাপত্যটি দৈর্ঘ্য ১৪.৬৩ মিটার এবং প্রস্থ ৪.৪১ মিটার। দুটি চার চালা ঘরের মাঝখানে একটি দো-চালা কুঁড়েঘরের সংমিশ্রণে এ মন্দির স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরটির সামনের দেয়ালে ৫টি প্রবেশপথ রয়েছে। এ মন্দিরটির প্রবেশপথগুলো বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। এ মন্দিরটির দেয়াল জুড়েও রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন চিত্রিত পোড়ামাটির অলঙ্করণ রয়েছে।

ছোট আহ্নিক মন্দির: পুঠিয়া রাজবাড়ির অন্যতম পুরাকীর্তি হল ছোট আহ্নিক মন্দির। পুঠিয়া ছোট আহ্নিক মন্দির নামে পরিচিত এ মন্দিরটি আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৭.২৩ মিটার এবং প্রস্থ ৪.৮৭ মিটার। এ মন্দিরটি মূলতঃ একটি দো-চালাবিশিষ্ট বাংলা কুঁড়ে ঘরের আদলে নির্মিত স্থাপনা। মন্দিরের সম্মুখভাগ পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। এ স্থাপত্যটি এক-বাংলা বা দো-চালা মন্দির নামেও পরিচিত। এটির পূর্বদিকে তিনটি প্রবেশপথ এবং দক্ষিণে একটি প্রবেশপথ রয়েছে। এ মন্দিরটির প্রবেশপথগুলোতে বহুমুখী খিলানের (multicusped) প্রতিফলন দেখা যায়। এ মন্দিরটির দেয়াল জুড়েও রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত হিন্দু মহাকাব্য এবং সামাজিক জীবন  চিত্রিত পোড়ামাটির অলঙ্করণ রয়েছে।

পুঠিয়া রাজবাড়িটি ১৭শ শতাব্দীতে মুঘল শাসন আমলে রাজশাহী অঞ্চলের পুঠিয়ায় প্রতিষ্ঠিত প্রাচীনতম জমিদার বাড়ি। কথিত আছে যে, নীলাম্বর নামে এক ব্যক্তি ১৬০৫ থেকে ১৬২৭ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি পাওয়ার পর পুঠিয়ায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর জমিদারি পরিচালনাকালে এ রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন। তবে ১৮৪৪ সালে এ জমিদারি ভাগ হয়ে যায়। এ বিভাজনের ফলে জমিদারের বড় ছেলে সাড়ে পাঁচ আনা এবং বাকি তিন ছেলে সাড়ে তিন আনা সম্পত্তি লাভ করে। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে পুঠিয়া রাজবাড়ির জমিদারিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু জমিদারি বিলুপ্ত হলেও সে আমলে নির্মিত তাদের প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা এখনও টিকে আছে। [মো. শাহীন আলম]


image source: Department of Archaeology, Bangladesh


reference: ১. Department of Archaeology, Bangladesh


রাজশাহী পুঠিয়া রাজবাড়ির পুরাকীর্তি


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


Leave a Reply