প্রাকৃতিক ভূগোলের দৃষ্টিভঙ্গি: শিলা, বায়ু, পানি ও জীবমণ্ডলের রহস্য

বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত প্রাকৃতিক ভূগোলের ক্ষেত্রে নিমিত্তবাদী (deterministic) ধারণাই প্রধান ছিল। পরবর্তীকালে সম্ভাবনাবাদ (possibilism) এবং নব্য-সম্ভাবনাবাদ (Neo-possibilism) গুরুত্ব লাভ করে। বর্তমান সময়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রকৌশলগত উন্নতির প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— প্রাকৃতিক ভূগোল কি সম্পূর্ণভাবে নিমিত্তবাদী, নাকি অনিমিত্তবাদী?

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের জন্য ভূ-বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতেন। তবে পরবর্তীতে উপলব্ধি করা হয় যে, এ ধরনের প্রয়োগ সবসময় যথার্থ নয়। একইভাবে প্রাকৃতিক ভূগোলকেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। মূলত প্রাকৃতিক ভূগোলকে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে—

১। শিলাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি (Lithosphere-based approach)
২। বায়ুমণ্ডলভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি (Atmosphere-based approach)
৩। বারিমণ্ডলভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি (Hydrosphere-based approach)

পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীতে এ তালিকায় জীবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি (biosphere-based approach) যুক্ত হয়।

প্রাকৃতিক ভূগোল মূলত বস্তুগত উপাদান নিয়ে গঠিত। প্রতিটি বস্তুর তিনটি মাত্রা রয়েছে, তবে এর সাথে সময়কে যুক্ত করলে দেখা যায়— কোনো বস্তুই কেবল ত্রিমাত্রিক নয়; বরং সবই চতুর্মাত্রিক। অর্থাৎ শিলামণ্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও জীবমণ্ডল—এ চারটি দৃষ্টিভঙ্গিই আসলে সময় দ্বারা আবদ্ধ একটি ৪-মাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যভাবে বলা যায়, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই প্রাকৃতিক ভূগোল সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি চার-মাত্রিক পদ্ধতি (four-dimensional method)।

পৃথিবীতে জীবের উপযোগী পরিবেশ

পৃথিবী ব্যতীত অন্য কোনো গ্রহ জীবের অস্তিত্বের জন্য উপযোগী বলে এখনও প্রমাণিত হয়নি। জীবের জন্য পৃথিবীর এ উপযোগিতা কয়েকটি নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ—

১। সূর্য থেকে পৃথিবীর মাঝারি দূরত্বে অবস্থান;
২। অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল; এবং
৩। পর্যাপ্ত পানি।

এ নিয়ামকগুলোর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় পৃথিবীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন—

  • মাঝারি মাত্রার সৌররশ্মি প্রাপ্তি;
  • সহনীয় তাপমাত্রার ভারসাম্য;
  • পানি বাষ্প, তরল ও কঠিন— সব অবস্থায় উপস্থিতি; এবং
  • এসবের ভিত্তিতেই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক পদ্ধতিসমূহের কার্যক্রম গড়ে ওঠে।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক পদ্ধতি

পৃথিবীকে একটি একক পদ্ধতি (system) হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে এ পদ্ধতি জটিল হওয়ায় এর সরলীকরণ প্রয়োজন হয়। এজন্য পৃথিবীর প্রাকৃতিক পদ্ধতিকে পাঁচটি উপবিভাগে ভাগ করা হয় —

১। জলবায়ু;
২। মৃত্তিকা;
৩। জীবজগৎ;
৪। পানি; এবং
৫। ভূমিরূপ।

প্রতিটি পদ্ধতিই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে জ্ঞানকে সংগঠিত করতে সহায়তা করে।

পদ্ধতির ধরন

পদ্ধতিকে সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় —

১। উন্মুক্ত পদ্ধতি (open system):

পৃথিবীর অধিকাংশ পদ্ধতিই উন্মুক্ত। এখানে বাহির থেকে শক্তি ও পদার্থ প্রবেশ করে এবং পুনরায় নির্গত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বায়ুমণ্ডলে সূর্য থেকে শক্তির আগমন ঘটে এবং তা পুনরায় মহাশূন্য বা পৃথিবীতে ফিরে যায়। এ চক্রকে তাপ সমতা বা তাপ বাজেট বলা হয়।
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বাহির থেকে আগত শক্তি সাময়িকভাবে অপরিবর্তিত থাকতে পারে, তবে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটায়। এ পরিবর্তন কখনও ধনাত্মক, কখনো ঋণাত্মক প্রতিফলন (feedback) তৈরি করে।

২। আবদ্ধ পদ্ধতি (closed system):

এ ধরনের পদ্ধতিতে বাহির থেকে কোনো সম্পদ প্রবেশ করে না এবং ভেতর থেকেও নির্গত হয় না। পৃথিবীর অশ্মমণ্ডল (lithosphere) এ ধরনের একটি উদাহরণ। কারণ মহাজাগতিক উল্কাপিণ্ড ছাড়া অশ্মমণ্ডলে কোনো নতুন উপাদান যুক্ত হয় না কিংবা বাহিরেও যায় না।

পদ্ধতিসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক

পৃথিবীর বহিরাবরণের বিভিন্ন উপপদ্ধতি একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং তারা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। যেমন —

জলবায়ু, মৃত্তিকা ও উদ্ভিদ পদ্ধতি। ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে মৃত্তিকার খনিজ পদার্থ নিচে সরে যায় এবং উপরিভাগে অক্সিজেনসমৃদ্ধ মৃত্তিকা অবশিষ্ট থাকে। আবার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে প্রচুর গাছপালা জন্মালেও দ্রুত জারণের ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি দেখা দেয়। এভাবে জলবায়ু, মৃত্তিকা ও জীবজগৎ পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। পৃথিবীর অন্যান্য উপপদ্ধতিও একইভাবে একটি সমন্বিত প্রাকৃতিক পদ্ধতির অংশ।


✍️ লেখক: মো. শাহীন আলম


🔗 সহায়িকা:
১। Singh, Savindra, (2009), Physical Geography, Prayag Pustak Bhawan, Allahbad, India;
২। রহমান, মোহাম্মদ আরিফুর, (২০১৭ – ২০১৮), কবির পাবলিকেশনস, ঢাকা;
৩। রউফ, কাজী আবদুর, (২০০২), প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা;
৪। রউফ, কাজী আবদুর, (২০১১), প্রাকৃতিক ভূগোল পরিচিতি, সুজনেষু প্রকাশনী, ঢাকা।


Follow Us on Our YouTube channel: GEONATCUL


দ্রাঘিমারেখার ব্যবহার: যে কোনো স্থান-দেশের সময়ের পার্থক্য নির্ণয়


Leave a Reply